বাংলাদেশের ষড়ঋতু রচনা |
ভূমিকা
বাংলাদেশ একটি ঋতুবৈচিত্র্যময় দেশ। এদেশে রয়েছে ছয়টি প্রধান ঋতু: বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত এবং শীত। প্রতিটি ঋতুর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, প্রতিটি ঋতুতেই বাংলার রূপ ভিন্নরকম হয়ে থাকে। কখনো শীত, কখনো তীব্রগরম কখনো আবার আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা ভাসে, ফুলের গাছে ফুল ফুটে, কৃষ্ণচূড়ার ডালে কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরে ওঠে। কোকিলের ডাকে ভরে ওঠে গ্রাম বাংলা। বাংলাদেশের ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য অসাধারণ।
বাংলাদেশের ঋতুসমূহঃ
- বসন্তকাল (মার্চ-এপ্রিল)
- গ্রীষ্মকাল (মে-জুন)
- বর্ষাকাল (জুলাই-আগস্ট)
- শরৎকাল (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর)
- হেমন্তকাল (নভেম্বর-ডিসেম্বর)
- শীতকাল (জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারি)
- বসন্তকাল (মার্চ-এপ্রিল)
বাংলার ঋতুরাজ বসন্তকাল। এটি বছরের শেষ ঋতু। ফাল্গুন-চৈত্র মিলে এই দুই মাস বসন্তকাল। শীতের পরেই আবির্ভাব ঘটে বসন্তের। বসন্ত হলো বছরের সবচেয়ে সুন্দর এবং মনোরম ঋতু। এ সময় নির্জীব প্রকৃতি তার যৌবন ফিরে পায়, জেগে ওঠে প্রকৃতি - ভরে ওঠে চারদিক সবুজে। পাতাঝরা গাছগুলিতে নতুন পাতা গজায়। এ সময় আবহাওয়া হালকা গরম এবং আকাশ পরিষ্কার থাকে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায় এবং ফুল ফোটে। বসন্তে দক্ষিণা হাওয়া বয়, পাখিদের কলরবে ভরে ওঠে বাংলার রূপ প্রকৃতি, মাতাল করে দেয় কবি মনকে।
বসন্তে বাংলার ধানক্ষেতগুলিতে ভরে যায় সবুজ ধানক্ষেতে, দক্ষিণা হাওয়াতে দোলখায় ধানক্ষেতগুলি, এলিয়ে পড়ে একজনের গায়ে আরেকজন। সবুজ ধানের চারা আনন্দে আন্দোলিত হয়ে ওঠে। বসন্তে কুকিলের কুহু কুহু কণ্ঠ ভারি অপরূপ, কুকিলের কণ্ঠে ভরে ওঠে গ্রাম বাংলা। মৌমাছিরা সারাদিন ব্যাস্ত থাকে মধু সংগ্রহে।
- গ্রীষ্মকাল (মে-জুন)
বসন্তের পরেই আগমন ঘটে গ্রীষ্মকালের। এটি বছরের প্রথম ঋতু। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এ দুই মাস মিলে গ্রীষ্মকাল। এ সময় আবহাওয়া তীব্র গরম। গ্রীষ্মকালে আগমন ঘটে বৈশাখী ঝড়ের, গাছপালা, ঘরবাড়ি উলটে যায় বৈশাখী ঝড়ে। গ্রামের কৃষকরা ব্যাস্ত থাকে বোরো ধান তুলতে, তাদের ভয় - এই বুঝি বৈশাখী ঝড়ে তলিয়ে যায় তাদের ধানক্ষেত।
গ্রীষ্মকালে নানা ধরনের মিষ্টি ফল পাকে। বিশেষকরে আম, জাম, কাঠাল, আনারস ইত্যাদি নানারকম বাহারি ফল। তাইতো গ্রীষ্মকালকে বলা হয় মধুময় ঋতু। যে দুই মাস মিলে গ্রীষ্মকাল বিরাজ করে, এই দুই মাসকে বলা হয় বাংলার মধুমাস।
গ্রীষ্মকালে গ্রাম বাংলায় ধুম পড়ে যায় আম কুড়নোর। বাতাসে আমের গাছগুলি দোল খায়, ঝড়ের দিনে গাছের দোলনে পাকা আমগুলো পড়ে মাটিতে, আনন্দে আম কুড়োয় গ্রাম বাংলার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা।
- বর্ষাকাল (জুলাই-আগস্ট)
গ্রীষ্মকালের পরেই আগমন ঘটে বর্ষার। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস মিলে বর্ষাকাল। এ সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিপাতের কারণে নদী-নালা-খাল-বিল পানিতে ভরে যায় এবং ফসলের ক্ষেত সবুজ হয়ে ওঠে। এ সময় মানুষ মাছ ধরতে, নৌকা ভ্রমণ করতে এবং বর্ষা বিলাস করতে পছন্দ করে।
বর্ষাকাল মানেই মেঘ বৃষ্টির বাংলাদেশ। এই মেঘ, এই বৃষ্টি। সারাদিন রিমঝিম বৃষ্টি পরে। কখনো ইলশেগুঁড়ি কিংবা কখনো মুশলধারে বৃষ্টি। থামার কোনো নাম নেই। একটু থামতেই আবার ঝড়তে শুরু করে। সমস্ত গাছাগাছালি সবুজ হয়ে যায়। নদী, নালা, খাল, বিল ভরিয়ে দেয়। বৃষ্টির সময়, গ্রামের ছেলে-মেয়েরা বৃষ্টিতে গোসল করা নিয়ে ব্যাস্ত। তারা নদীতে ঝাপ দেয়। সাতার কাটে। বর্ষায় আনন্দে কাটে গ্রাম বাংলার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের।
বর্ষা এমনই এক ঋতু, যে ঋতু মানুষকে হাসাতে পারে, কাঁদাতে পারে, বর্ষা ভালোবাসায়, মনে করিয়ে দেয় প্রিয় মানুষটার কথা। বর্ষার ভারি বৃষ্টির বর্ষনে তলিয়ে দেয় গ্রাম, গর্জে ওঠে নদী-নালা। মাঝিরা নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পরে মাছ ধরতে, গান গায় মধুর সুরে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা কলাগাছের ভেলা বানায়, ভাসায় নদীতে - ছুটে চলে বহুদূরে। বর্ষায় ব্যাঙ্গের ঘ্যাংগর ঘ্যাংগর ধ্বনিতে মুখোরিত থাকে গ্রাম বাংলা। ছেলেমেয়েরা বৃষ্টিতে বাড়ি ফিরে কলাপাতার ছাতা বানিয়ে।
- শরৎকাল (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর)
বর্ষাকালের পরেই আগমন ঘটে শরৎকালের। ভাদ্র-আশ্বিন এই দুই মাস মিলে শরৎকাল। শরৎকালে প্রকৃতি অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। শরতের সৌন্দর্য বাংলার প্রকৃতিকে করে তুলে রূপময়, আর তাই এটি বছরের সবচেয়ে রঙিন ঋতু। এ সময় গাছের পাতা হলুদ, লাল এবং বাদামী রঙে রঙিন হয়ে যায়। আকাশে ভাসে শুভ্র মেঘের ভেলা। নীল আকাশে উড়ে বেড়ায় পাখির ঝাঁক। বেয়ে চলে চারদিক জুরে মিষ্টি হাওয়া। তাইতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎকালকে নিয়ে লেখেন;
“আজি ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায়
লুকোচুরির খেলা,
নীল আকাশে কে ভাসালে
সাদা মেঘের ভেলা।”
শরতের আবহাওয়া ভারি অপরূপ। এ সময় গ্রীষ্মের তীব্র গরম কিংবা শীতের প্রচণ্ড ঠান্ডা কোনটিই থাকেনা। আবহাওয়া থাকে বেশ আরামদায়ক। হালকা বাতাস বয় চারদিক জুড়ে। রঙ্গিন করে তুলে বাংলার প্রকৃতি। নদীর ধারে ফুটে কাশফুল। এছাড়াও ফুটে শিউলি, শেফালি, পদ্ম ইত্যাদি নানা ধরনের ফুল।
- হেমন্তকাল (নভেম্বর-ডিসেম্বর)
শরৎকালের পরেই আগমন ঘটে হেমন্তকালের। কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাস মিলে হেমন্তকাল। হেমন্ত হলো এক অপরূপ রুপের ঋতু। এ ঋতুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের হাসি কান্না। হেমন্তের রয়েছে অনন্য কিছু বৈশিষ্ঠ। হেমন্তের শুরুর দিকে অনুভূতি এক এবং শেষের দিকে আরেক অনুভূতি।
কৃষকের ঘরে ঘরে আনন্দের ধারা বয়ে যায়। মাঠের সোনালী ধান পাকে হেমন্তে, কৃষকেরা ব্যাস্ত ধান কেটে ঘরে তুলতে। গ্রাম বাংলায় লেগে যায় ধান কেটে নবান্নের উৎসব। কৃষক-কৃষাণির আনন্দ সবই হেমন্তের রূপের অণুষঙ্গ।
হেমন্তকালে শুরু হয় শীত গরমের খেলা। হেমন্তের শুরুর দিকে কিঞ্চিৎ গরম থাকে ভরা দুপুরে, কিন্তু রাতে ও সকালে বেশ ফুরফুরে ঠান্ডা থাকে, বাতাস বয়। হেমন্তের সকালে শিশির কণা জমে ঘাসের ডগায়। হালকা শীত পরে। হেমন্তের শেষের দিকে আবহাওয়া ঠান্ডা হতে শুরু করে। এ সময় শুরু হয় খেজুর গাছে রস সংগ্রহ এবং আলু তোলার প্রস্তুতি।
- শীতকাল (জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারি)
শরতের পরেই আবির্ভাব ঘটে শীতকালের। পৌষ-মাঘ এই দুই মাস মিলে শীতকাল। এ সময় তীব্র ঠান্ডা থাকে। হিম শীতল হাওয়া বয়। ঘন কুয়াশায় ছেয়ে যায় চারদিক। গ্রাম বাংলায় শীতের কুয়াশার দৃশ্য ভারি অপরূপ। দূর দূরান্তে কিছুই দেখা যায়।
শীতের সকালে গ্রাম-বাংলায় কুয়াশার চাঁদর দিয়ে ঢাকা থাকে। গ্রামের ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে যেনো উঠতেই ইচ্ছা করে না কাথা-কম্বল ছেড়ে। শীতের তীব্র ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে তারা চলে মক্তবের দিকে।
শীতের সকালে গ্রামের প্রৌঢ় লোকেরা সকালে ওঠে হাটতে বের হয়, গ্রামের ছোট-বাজারে লেগে যায় চায়ের আড্ডা। ছেলেমেয়েরা খড়কুটো দিয়ে আগুণ জ্বলায় - চোখে পড়ে আগুণ পোহানোর দৃশ্য। শীতের সকালে লেগে যায় পিঠাপুলির মেলা। খেজুঁর গাছের মাথায় ঝুলে থাকে মিষ্টি রসের হাঁড়ি।
উপসংহার
বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুর প্রতিটিই নিজস্ব সৌন্দর্যময়। এ ঋতুগুলির পরিবর্তন আমাদের জীবনে আনন্দ, উৎসাহ এবং নতুনত্ব এনে দেয়।
এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।