ব্যাংকিং সিস্টেমের অদ্যোপান্ত: ব্যাংক যেভাবে চলে | যেভাবে ঘোরে অর্থনীতির চাকা |

MD Nazir Hossain

July 19, 2025

✍️ হতে চান লেখক? উইব্লগবিডিতে এখন যেকেউ লিখতে পারবেন। রেজিস্ট্রেশন করুন

বর্তমান ডিজিটাল যুগে আমরা একটি অ্যাপের ক্লিকে বিল পরিশোধ করি, কার্ড ঘষে কেনাকাটা সারি, কিংবা ভবিষ্যতের সুরক্ষায় টাকা জমিয়ে রাখি। এই সবকিছুর পেছনে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে এক বিশাল ব্যবস্থা, যার নাম ব্যাংক। ব্যাংক শুধু টাকা জমানোর লকার নয়, এটি একটি দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এই বিশাল প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক কীভাবে কাজ করে? কোথা থেকে তাদের আয় আসে এবং কীভাবে তারা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে?

চলুন, আজ ডুব দেওয়া যাক ব্যাংকিং ব্যবস্থার গভীরে এবং জেনে নেওয়া যাক এর আদ্যোপান্ত।

ব্যাংক কী? শুধু টাকার ভান্ডার নয়, অর্থনীতির চালিকাশক্তি

সহজ কথায়, ব্যাংক হলো একটি সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর মূল কাজ হলো যাদের কাছে উদ্বৃত্ত টাকা আছে, তাদের থেকে সেই টাকা আমানত হিসেবে সংগ্রহ করা এবং যাদের টাকার প্রয়োজন, তাদের সেই টাকা ঋণ হিসেবে প্রদান করা।

কিন্তু ব্যাংকের পরিচয় এর থেকেও অনেক বড়। ব্যাংক একটি সেতুর মতো কাজ করে, যা সঞ্চয়কারী এবং বিনিয়োগকারীর মধ্যে সংযোগ ঘটায়। এই সংযোগের মাধ্যমেই একটি দেশের অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ (Cash Flow) সচল থাকে এবং উন্নয়নের চাকা ঘুরতে থাকে।

ব্যাংকের পথচলার মূল ভিত্তি: প্রধান কাজগুলো কী কী?

একটি ব্যাংককে সচল রাখতে এবং গ্রাহকদের সেবা দিতে প্রতিদিন অসংখ্য কাজ করতে হয়। এর মধ্যে প্রধান কাজগুলো হলো:

১. আমানত সংগ্রহ (Accepting Deposits)

এটি ব্যাংকের মৌলিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা জমা নেয়। যেমন:

সেভিংস অ্যাকাউন্ট (Savings Account): সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়াতে এই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার হয়। এখানে টাকার উপর সামান্য হারে সুদ বা মুনাফাও পাওয়া যায়।

কারেন্ট অ্যাকাউন্ট (Current Account): মূলত ব্যবসায়ী এবং সংস্থাগুলোর জন্য এই অ্যাকাউন্ট। এখানে দিনে বহুবার লেনদেন করা যায়, তবে সাধারণত কোনো সুদ বা মুনাফা দেওয়া হয় না।

ফিক্সড ডিপোজিট বা এফডিআর (Fixed Deposit Receipt – FDR): নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য একবারে বড় অঙ্কের টাকা জমা রাখা হয়। এর বিনিময়ে ব্যাংক তুলনামূলক উচ্চ হারে সুদ বা মুনাফা প্রদান করে।

ডিপিএস (Deposit Pension Scheme): প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রেখে মেয়াদ শেষে লাভসহ বড় অঙ্কের টাকা ফেরত পাওয়ার একটি জনপ্রিয় সঞ্চয় পদ্ধতি।

২. ঋণ প্রদান (Providing Loans)

ব্যাংকের লাভের মূল উৎসই হলো ঋণ প্রদান। মানুষের জমানো টাকা অলস ফেলে না রেখে ব্যাংক সেই টাকা বিভিন্ন খাতে ঋণ হিসেবে খাটায়। ঋণের কয়েকটি জনপ্রিয় ধরণ হলো:

ব্যক্তিগত ঋণ (Personal Loan): বিয়ে, ভ্রমণ, চিকিৎসা বা যেকোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এই ঋণ নেওয়া যায়।

গৃহঋণ (Home Loan): বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন পূরণে ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়।

ব্যবসা ঋণ (Business Loan): ছোট-বড় ব্যবসা শুরু করতে এই ঋণ অপরিহার্য।

শিক্ষা ঋণ (Student Loan): দেশে বা বিদেশে উচ্চশিক্ষার খরচ মেটাতে ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে।

৩. বিনিয়োগের বিশাল জগৎ (Investment)

ব্যাংকগুলো কেবল ঋণ দিয়েই অর্থ উপার্জন করে না, তারা বিভিন্ন লাভজনক খাতে বিনিয়োগও করে। যেমন:

সরকারি বন্ড ও ট্রেজারি বিল: সরকার যখন উন্নয়নের জন্য টাকা তোলে, তখন ব্যাংক এই বন্ডগুলো কিনে নেয়। এটি একটি নিরাপদ বিনিয়োগ এবং এখান থেকে নির্দিষ্ট হারে আয় হয়।

শেয়ার বাজার: কিছু ব্যাংক নিজেদের পোর্টফোলিওর একটি অংশ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে অধিক মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে।

অন্যান্য প্রকল্পে বিনিয়োগ: বড় বড় শিল্প বা অবকাঠামো প্রকল্পে ব্যাংক সরাসরি বিনিয়োগ করে লাভের অংশীদার হয়।

৪. বাণিজ্যিক লেনদেন ও ট্রেড ফাইন্যান্স (Trade Finance)

আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যাংক ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিক্রেতা এবং ক্রেতার মধ্যে আস্থা তৈরি করতে ব্যাংক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। যেমন:

লেটার অফ ক্রেডিট বা এলসি (Letter of Credit – LC): আমদানিকারকের পক্ষ হয়ে রপ্তানিকারককে টাকা পরিশোধের নিশ্চয়তা দেয় ব্যাংক। এর ফলে দুজন অপরিচিত ব্যবসায়ী একে অপরের সাথে নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে পারে।

ব্যাংক গ্যারান্টি (Bank Guarantee): কোনো চুক্তি পালনের নিশ্চয়তা হিসেবে ব্যাংক এই সেবা দেয়।

৫. অর্থ প্রেরণ ও মুদ্রা বিনিময় (Remittance & Foreign Exchange)

বিদেশ থেকে প্রবাসীদের কষ্টার্জিত টাকা দেশে পাঠানো (রেমিটেন্স), কিংবা বিদেশে লেখাপড়া বা ব্যবসার জন্য টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়াটি ব্যাংক সম্পন্ন করে। এছাড়া এক দেশের মুদ্রার সাথে অন্য দেশের মুদ্রা বিনিময়ের (Foreign Exchange) কাজও ব্যাংক করে থাকে এবং এখান থেকে কমিশন আয় করে।

ব্যাংকের লাভের রহস্য: আয় আসে কোথা থেকে?

ব্যাংকের ঝাঁ-চকচকে ভবন আর আধুনিক সেবা দেখে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, তাদের আয়ের উৎস কী? ব্যাংক মূলত কয়েকটি উপায়ে লাভ করে:

১. সুদের হারের পার্থক্য বা স্প্রেড (Interest Rate Spread)

এটিই ব্যাংকের লাভের প্রধান ইঞ্জিন। ব্যাংক আমানতকারীদের যে হারে সুদ দেয় (ধরা যাক ৪%), তার চেয়ে বেশি হারে ঋণগ্রহীতাদের থেকে সুদ আদায় করে (ধরা যাক ৯%)। এই দুই সুদের হারের পার্থক্যই (৯% – ৪% = ৫%) হলো ব্যাংকের মোট লাভ বা স্প্রেড। এই স্প্রেড যত বেশি হয়, ব্যাংকের লাভও তত বাড়ে। একেই Loan Interest থেকে আয় বলা হয়।

২. বিনিয়োগ থেকে মুনাফা (Profit from Investment)

সরকারি বন্ড, শেয়ার বাজার বা অন্যান্য প্রকল্পে বিনিয়োগ করে ব্যাংক যে লভ্যাংশ বা মুনাফা পায়, তা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ।

৩. ফি এবং সার্ভিস চার্জ (Fees and Service Charges)

ব্যাংক তার গ্রাহকদের বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য ছোট ছোট চার্জ বা ফি আরোপ করে। এগুলো পরিমাণে কম হলেও সম্মিলিতভাবে ব্যাংকের আয়ে বড় ভূমিকা রাখে। যেমন:

  •  অ্যাকাউন্ট ম্যানেজমেন্ট ফি
  • চেক বইয়ের ফি
  • এটিএম কার্ডের বার্ষিক ফী
  •  অনলাইন লেনদেন বা ফান্ড ট্রান্সফার চার্জ
  • ঋণ আবেদন বা প্রসেসিং ফি

৪. কমিশন ভিত্তিক আয় (Commission-based Income)

ট্রেড ফাইন্যান্স (যেমন এলসি ও ব্যাংক গ্যারান্টি) এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ সেবা
প্রদানের জন্য ব্যাংক নির্দিষ্ট হারে কমিশন আদায় করে, যা তাদের আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

একটি ভিন্ন ধারা: ইসলামী ব্যাংকিং কীভাবে কাজ করে?

বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার
পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত জনপ্রিয়। এর মূল ভিত্তি হলো এখানে সুদের (আরবীতে ‘রিবা’) কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে তারা লাভ করে কীভাবে?

ইসলামী ব্যাংকগুলো লাভ-লোকসানের ভাগাভাগি (Profit-Loss Sharing) নীতির উপর চলে। এখানে ব্যাংক গ্রাহকের টাকার আমানতকারী নয়, বরং অংশীদার। ব্যাংক সেই টাকা শরীয়াহসম্মত বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। ব্যবসা থেকে যে লাভ হয়, তা পূর্বনির্ধারিত চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংক এবং গ্রাহকের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হয়। একইভাবে লোকসান হলেও উভয় পক্ষ তা বহন করে।

ইসলামি ব্যাংকের কিছু জনপ্রিয় বিনিয়োগ পদ্ধতি হলো:

মুদারাবা: গ্রাহকের টাকা দিয়ে ব্যাংক ব্যবসা করে এবং লাভের অংশ ভাগ করে নেয়।

মুশারাকা: গ্রাহক ও ব্যাংক উভয়েই মূলধন বিনিয়োগ করে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা করে।

ইজারা: ব্যাংক কোনো সম্পত্তি (যেমন গাড়ি বা যন্ত্রপাতি) কিনে গ্রাহককে ভাড়া দেয়।

কেন ব্যাংকিং ব্যবস্থা এত গুরুত্বপূর্ণ?

অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালন: ব্যাংক ছাড়া একটি দেশের অর্থনীতি অচল। এটি সঞ্চয়কে বিনিয়োগে রূপান্তর করে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখে।

কর্মসংস্থান: ব্যাংকিং খাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে।

সঞ্চয়ের নিরাপত্তা: ব্যাংক মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চয়কে নিরাপদে রাখে এবং এর উপর মুনাফা দিয়ে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করে।

ব্যবসার চালিকাশক্তি: ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই নতুন ব্যবসা জন্মায় এবং পুরোনো ব্যবসা প্রসারিত হয়।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় এনে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটায়।

ব্যাংকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস

বাহিরের দেশে বা ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে, যেমন বাহিরের দেশ থেকে কোনো পণ্য কেনার ক্ষেত্রে। বা ধরুন ফেসবুকে কোনো কিছু বুস্ট করার ক্ষেত্রে, আমাদের ব্যাংকের ডেবিট কার্ড নিতে হয়। এবং এই ডেবিট কার্ড দিয়ে যত ডলার ট্রানজেকশন করা হবে, তার উপর ১৫% ভ্যাট কাটা হয়। যেটা পুরোটা ব্যাংকের লাভ।

উপসংহার

সুতরাং, ব্যাংক কেবল একটি টাকা লেনদেনের কেন্দ্র নয়, এটি একটি জটিল ও সুসংগঠিত ব্যবস্থা যা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে সচল রাখে। আমানত গ্রহণ, ঋণ প্রদান, এবং কৌশলগত বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা মুনাফা অর্জন করে এবং সেই মুনাফার একটি অংশ গ্রাহকদের ফিরিয়ে দিয়ে পুরো ব্যবস্থাটিকে টেকসই করে তোলে। সুদভিত্তিক আধুনিক ব্যাংকিং হোক বা লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের ইসলামী ব্যাংকিং, উভয় ব্যবস্থাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক অপরিহার্য স্তম্ভ।

বই পড়ার অভ্যাস আমার সেই ছোট থেকেই, বই পড়তে ভালোবাসি আমি। এটা আমার নেশা। বই পড়ার মধ্য দিয়েই তো মানুষ আলোকিত হতে পারে। কাজেই আসুন বেশি বেশি বই পড়ি। বইয়ের আলোয় আলোকিত হই।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করার আগে খেয়াল রাখুন যেন ভদ্র ভাষা ব্যবহার করা হয়।