ভূতুড়ে গল্প - সেই রাত (নাজির হোসেন)

Nir
0


ঝোপঝাপের মধ্যে গ্রামখানা তৈরি হয়েছে কয়েকটি ঘর মিলে। পিচঢালা রাস্তা ধরে জমি খেতের মাঝ দিয়ে ছোট নদী পেড়িয়ে যেতে হয়। স্থানীয় ভাষায় নদী'কে বলে গাং। সকালে বেশ পানি থাকে, দুপুরে হাটুজল এবং রাত্রিতে পানি থাকে অনেক কম। পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে এ পানি আসে, তাই এ গাং-এর পানি কখনো ফুরিয়ে যায় না।

বড় ভাইয়ের বিয়ে হবার এক বছর পর আমার প্রথম যাওয়া ভাই-ভাবির সাথে শ্রীমঙ্গলে, ভাইয়ের শশুর বাড়িতে। তাদের গ্রামখানা অনেক সুন্দর। মাটি দিয়ে তৈরি বাড়ির সংখ্যা বেশি। গ্রামের নাম নলুয়ারপাড়। তবে আমার বেশি ভালো লেগেছিলো সেই গ্রামের মানুষের ব্যবহার।

এখানে আমার সমস্যা হয়েছিলো অবশ্যি গোসল করা ও খাওয়া করা নিয়ে। এখানকার রান্না একদম ভিন্ন। কয়েক'টি বাড়ির মাঝে একটি মাত্র টিউবল। খোলামেলা ভাবে, ঘেড়া নেই। গোসল করতে হয় নদীতে বা পুকুরে। এখানে পুকুরকে বলে পুসকুনি।

ভাবির চাচাতো বোনের বিয়ে হবার দৃতীয় দিন। বিয়ের আগের দিন ভাবির ভাই চট্রগ্রাম থেকে তার স্ত্রী ও শালীকে নিয়ে আসায় আজ থাকতে কষ্ট হওয়ায় তারা ভাবির বড় বোনের বাড়িতে থাকতে গেছে। অবশ্যি আমাদের সেখানে যাবার কথা ছিলো, আমার কারণে হলো না। তাই আমরা এখানেই থেকে গেলাম।

গভির রাত। আনুমানিক বারো'টা পেড়িয়ে গেছে। ভাবি আমাদের জাগিয়ে তুললে। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। বড় ভাই উঠলো, আমি উঠলাম।
ভাবি ভাইকে বললে;
- তারাতারি উঠে ওই বাড়িতে যাওতো।
ভাই বললে;
- কেন? কি হয়েছে এতো রাত্রিতে।
তখন তাওয়াই এসে বললে;
- শামীমের শালীর নাকি কি হয়েছে। অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ওই বাড়ি থেকে ফোন করে এখুনি ডাকল, জামাইবাবু আপনি এখুনি বেরুন।
আমার ভাই বললে;
- আচ্ছা বেরুচ্ছি।

মীনারা হলো ভাবির ভাইয়ের শালী। একমাত্র শালী। এখনো খুকি বাচ্চা। বয়স আনুমানিক সাত-নয় হবে বৈ কি। তবে এই বয়সেই অনেক চালাক। বেশ কথা বলতে পারে।

ভাই, তাওয়াই ও ভাবির মামা যখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন আমি ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম;
- ভাই আমিও যাবো।
ভাই বললে;
- তোর যেতে হবে না, ঘুমিয়ে পর।

এ বিষয়ে আমার একটু কৌতুহল বেশি। ভাইয়ের কথায় মনটা হয়ে গেলো ভিশন খারাপ। তখন ভাবি ভাইকে বললে;
- যাক না ও সাথে। ভূত বিশ্বাস করে না, নিজ চক্ষে দেখে আসুক।
আমার দিকে তাকিয়ে বললে;
- তুমিও যাও সাথে।

আমি তো খুশিতে একশো ওয়ার্ড বাল্ফের ন্যায় উজ্জল হয়ে গেলাম। আমার যাওয়াটা হচ্ছে তবে।
ভাবি এসে সকলের কানে সরিষার তেল দিতে বললে। সরিষার তেল কানে দিলে নাকি অশুভ কিছু কাছে চাপতে পারে না। তাই আমাকেও দিতে হলো।

শ্রীমঙ্গলের গ্রাম অঞ্চলের মানুষ ভূত-পেত সব বিশ্বাস করে। অবশ্যি এর পেছনে কারণ ও আছে। এ অঞ্চলে নানান অলৌকিক কিছু ঘটে। যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তারা বোঝে না, শুধু জানে এ অলৌকিক কিছু শক্তি। ঝোপ-ঝাপ বন, পাখির কলরব চা-বাগান আর পাহাড়ে ঘেড়া এ অঞ্চল। ভারি সুন্দর-ভারি অপরূপ-ভারি রহস্যময়।

নলুয়ারপাড় থেকে দূর্গানগর বেশিদূরে নয়। পায়ে হেটে দশ মিনিটের পথ। অন্ধকার নিস্তব্ধ রাত। একটু শব্দ হতেই যেনো মনে হয় অশরীরী কিছু। ছোট একটা রাস্তা। যখন হাটছি আমরা, তখন বেশ গা ছমছম করা অবস্থা। পথের দূ-ধারে ধানক্ষেত। এদিকে সামান্য কিছু ধানক্ষেত কিন্তু দূর্গানগরের ওদিকে কোনো ধানক্ষেত নেই, শুধুই চা-বাগান আর পাহাড়ি জঙ্গল।

মিনিট দশেক হাটার পর আমরা পৌছে এলাম দূর্গানগরে। ভাবির বড় বোনের বাসাটা বাসঝাড়ের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। গাছগাছালিতে ভরা, সাড়ি সাড়ি মাটির বাড়ি।
যখন বাড়িতে প্রবেশ করলাম, তখন মীনারা মোটামুটি স্বাভাবিক হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক কিছু আচরণ করছে।
তাওয়াই সব কিছু জানতে চাওয়ায় মীনারার বড় বোন মানে ভাবির ভাইয়ের স্ত্রী বললে;
- দুলাভাই ফিরে এসেছে। অনেকক্ষন ধরে বলছে এখানে ওখানে।

দুলাভাইয়ের নাম তো মীনারা জানে না। কিন্তু তার সম্পর্কে নানান সব বলছে৷ আর বলছে ওই যে ও ফিরে এসেছে। এ বাড়িতে থেকো না।
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম;
- যদি কারো কাছ থেকে জেনেছে? আর অসুখ হয়ে সেগুলো বলছে?
- না, আমার বোন কারো কাছ থেকে জানে নাই। তিনি ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলে।

আমি বসে আছি মাটিতে তুলে। তাওয়াইর কাণ্ডকারখানা দেখছি মনোযোগ দিয়ে বসে বসে। তিনি নানান সব দোয়া দরুদ পড়ছে। একটা ছোট পাতা ছিড়ে তার মধ্যে লিখছে আরবি কিছু।
ঠিক তখন আমি মীনারার দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলুম সে কাপছে। স্বাভাবিক কাপুনি নয়, রীতিমত থমথম করে কাপা। তখনি অদ্ভুত একটা শব্দ করে বললে;
- ওই যে! ওই যে! আবার এসেছে! হাতের আঙ্গুল একবার এদিক একবার ওদিক করে।
তাওয়াই আলেম মানুষ। তিনি সাথে সাথে কিছু দোয়া দরুদ পড়ে ফু দিতেই স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
আপার বড় মেয়ে। সে বললে;
- আরো আগে এলে দেখতেন, কি সব ভয়ংকর কথাবার্তা।

আপার বড় মেয়েটা তখন নবম শ্রেনীতে পড়ে। বড় ভালো মেয়ে সে। অনেক ভূতুরে গল্প তার জানা। সেগুলি নাকি সব সত্য। আমি তো তার থেকে একদিন শুনে অন্ধকারে বেরুতেই পারিনে।
সেই মুহুর্তে আমিও যে ভয় পাই নাই তা নয়। যতই ভূত বিশ্বাস না করি কেন, ভয়ের কথা শুনলে ঠিকই ভয় পাই।
তাওয়াই দোয়া দরুদ পড়ে পানির মধ্যে ফু দিয়ে মীনারার গায়ে ছিটিয়ে দিলেন। কানে অবশ্যি আগেই সরিষার তেল দেয়া হয়েছে। এখন সে পুরোপুরি স্বাভাবিক। তাওয়াই বললে;
- আর কোনো চিন্তা নেই, এখন আর কিছুই হবে না।
ভাবির ভাইয়ের স্ত্রী যখন ভূত-পেতের কথা তুললে, তখন আমি স্রেফ বলে দিলাম;
- ও সব ভূত পেত কিছু নেই। আমি বিশ্বাস করিনে।
তখন তিনি ভ্রু কুচকে বললে;
- অ্যঃ ভূত পেত নেই! একদিন রাত্রে এই গ্রামের টয়লেটে ডুবে দেবো তখন বুঝবে ভূত পেত আছে কি নেই।
- বুঝতে হলে রাত্রে আমাকে বাথরুমের মধ্যে বসে থাকতে হবে!

এ বাড়িতে আমার এই রাত্রিতে থাকার কোনো ইচ্ছা ছিলো না। কারও নেই। কিন্তু আমার ভাই, সে ঘুমু ঘুমু ভাব করে আছে। যার কারনে আর ফিরে যাওয়া হলো না। আপা চা করে দিলো, বিস্কুট দিয়ে ভিজিয়ে খেলাম আমরা। চা অবশ্যি আমি বেশি একটা খাইনে, কিন্তু শ্রীমঙ্গলের চায়ের যা স্বাদ, না খেয়ে পারিনে।
রাত অনেক গভির, দু'টা বেজে গেছে। জেগে থাকা আর সম্ভব নয়। লোক সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। পাশের ঘরে আমি, আমার ভাই, তাওয়াই, তাওয়াই'র শালা এসে শুয়ে পড়লাম। শীতের সময় গাদাগাদি হয়ে থাকা বেশ আরামের।
আমার চক্ষু যখন তন্দ্রায় জর্জরিত, তখন দেখলাম এক বিদঘুটে স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন'টা আমাকে যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো, বাকি'টা সময় আর দু'চোখের পাতা এক করতে পারি নাই।

২৫/০৫/২০২০

Post a Comment

0Comments

এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!