আপনি এমন কোনো মুভি দেখেছেন যে মুভিতে কোনো ভিলেন নেই, কোনো নায়ক নেই, নেই কোনো একক প্রেম কাহিনী?
এমনই একটা মুভির নাম মুজিজে, টার্কিস বিখ্যাত মুভিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি মুভি। মুজিজে একটা টার্কিস শব্দ, যার অর্থ অলৌকিক। এই মুভিটা দেখলে আপনি অভিভূত হয়ে যাবেন। হতভম্ব হয়ে যাবেন। এতো দারুন মুভি কেমনে বানা সম্ভব! মূলত এই মুভিটা ১৯৬০ সালের একটা বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
সিনেমার কাহিনীটা শুরু হয় এভাবে, শিক্ষক মাহির ইলমাজ নামের একজন সরকারী স্কুলের শিক্ষক। শিক্ষকতার দরুন হঠাত তার বদলি হয়ে যায় অনেক দূরের এক পাহাড়ি অজপাড়াগায়ে। সেখানে শহরের কোনো সুবিধা নেই, উন্নতির ছোয়া সেখানে তখনো পৌছায়নি। এখানকার মানুষদের বছরের ছয় মাস বাঁচতে হয় সংগ্রাম করে, কারন বছরের ছয় মাস এই গ্রামখানি তুষার দ্বারা আবৃত থাকে। সেখানে নেই কোনো বিদ্যুতের ব্যবস্থা, যাতায়াতের রাস্তাটি পর্যন্ত নেই। যেখানে রাস্তাটা শেষ হয়েছে সে পথের, সেখান থেকে দুইটা পাহাড় একটা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। দূর্গম পাহাড়ি পথ।
তার বদলি হওয়ার পর তিনি তার স্ত্রীকে বোঝালে তিনি কোনো ভাবেই রাজি হননা, কোনো ভাবেই যেতে দিবেন না তাকে। এ নিয়ে কিঞ্চিৎ ঝগড়াও হয় তার স্ত্রীর সাথে। অনেক কষ্টে মাহির তার স্ত্রীকে বুঝিয়ে সেই দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় পাড়ি দেয়।
মাহির এলমাজ সেই গ্রামে গেলে সবাই তাকে দেখে চমকে যায় যখন সেই গ্রামবাসী শুনেন তিনি একজন শিক্ষক। বিগত বিশ বছর ধরে সরকারের কাছে আবেদন করে আসছেন গ্রাম বাসী একজন শিক্ষকের জন্য, কিন্তু এই দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে কোনো শিক্ষকেই আসেননি। বিশ বছরপর পূর্ণরায় তাদের গ্রামে একজন শিক্ষকের আবির্ভাব ঘটলে তাঁরা সকলেই আনন্দিত বোধ করে। এবার তাদের সন্তানরা অন্তত পড়ালেখা করতে পারবে, শিক্ষিত হতে পারবে।
কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় সেই গ্রামে যে স্কুলটি ছিলো সেটার অস্তিত্ব ততদিনে বিলীন হয়ে গেছে। নতুন করে স্কুল বানানো দরকার। কিন্তু সেটার জন্য প্রয়োজন অনেক অর্থের। সরকারকে আবেদন করলে সরকার বলে এটা সময় সাপেক্ষের ব্যাপার। তখন শিক্ষক মাহির ইলমাজ একটা ফন্দি আটেন, তিনি তার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে বলেন তিনি দস্যুদের হাতে বন্দি, তাঁরা টাকা দাবী করেছেন, টাকা না পাঠালে মুক্ত করবেন না। এতে কাজ হয়ে যায়, শিক্ষক ইলমাজের স্ত্রী টাকা পাঠান। সেই টাকা নিয়ে তিনি ফিরে যান সেই গ্রামে, সকলের সহযোগিতায় দূর্গম পাহাড়ের সেই গ্রামে একটি স্কুল তৈরি হয়ে যায়।
(স্পয়লার এলার্ট, মুভিটা দেখে এসে এই অংশটুকু পড়তে পারেন, এই মুভি মিস করছেন তো অনেক বড় কিছু মিস)
মাহির এলমাজের সেই গ্রামে পদচারনের পর গ্রামের সকলের কাছে তিনি প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেন। মাহির এলমাজেরও গ্রামের সকলকে ভালো লেগে যায়। গ্রামটি ছিলো খুবই সুন্দর, যেনো পৃথিবীর বুকে একটুকরো সর্গ। গ্রামের মানুষরা প্রত্যেকেই সহজ সরল এবং অদ্ভুত রকমের ভালো মানুষ। প্রত্যেকের ব্যবহার অমায়িক।
গ্রামে স্কুলটি হওয়ার পর তিনি স্কুলে পাঠদান শুরু করেন। এভাবে চলতে থাকে সিনেমার কাহিনী। এই সিনেমার প্রধান চরিত্র আজিজ। আজিজ একজন প্রতিবন্ধী। যদিও আজিজকে আপনার প্রধান চরিত্র মনে হবেনা, এ সিনেমায় প্রত্যেকেই আমার কাছে প্রধান চরিত্র মনে হয়েছে।
এই মুভিতে বিয়ের প্রথাটা দারুন। বিয়ের আগে কনে বরকে দেখতে পারবেনা, বর কনেকে দেখতে পারবেনা। গ্রামের সবচেয়ে বড় অবিবাহিত যুবক যিনি, প্রথমে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের জন্য বর পক্ষ থেকে কয়েকজন মহিলা কনেকে দেখতে যান, কনেকে প্রশ্ন করা হয় কুরআনের নানা আয়াত ধরেন, নামাজ পড়েন কিনা জিজ্ঞেস করেন, এভাবে পছন্দ হলে তার সাথে বিয়ে হয়ে যায়, বাসর রাতে বর কনেকে দেখতে পারেন। পুরোটা ডিফেন্ড করে ভাগ্যের উপর। যে যেরকম স্ত্রী পান তাতেই তিনি খুশি।
আজিজেরও বিয়ে করার তীব্র ইচ্ছা, কিন্তু প্রতিবন্ধী হওয়ার দরুন সে বিয়ে করতে পারেন না অথচ তার বাকি পাঁচ ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
শিক্ষক মাহির ইলমাজের আজিজকে ভালো লেগে যায়, তার জন্য মায়া কাজ করে। তিনি বিশ্বাস করেন তাকে পাঠদান দেয়া সম্ভব। নিজ উদ্যোগে শিক্ষক মাহির ইলমাজ আজিজকে পাঠদান দেয়া শুরু করেন, তাকে সুস্থ করার উদ্যোগ নেন। শিক্ষক মাহির এলমাজ যখন বাচ্চাদের স্কুলে তাকে নিয়ে পড়াতেন, গ্রামের প্রত্যেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো, দেখে তাদের এতোটাই ভালো লাগতো এতটাই মন প্রশান্তিতে ভরে যেতো যে চোখে যেনো আনন্দের অশ্রু পড়তে শুরু করে। লোকে বলে, শিক্ষকমশাই বড় ভালো লোক।
মুভিটার এই অংশটা থেকে এর পরের পুরো কাহিনীটা এতোটাই দারুন যে আপনি কঠিন হৃদয়ের মানুষ হলেও নিজের অজান্তেই আপনার চোখ ভিজে উঠবে আনন্দের অশ্রুতে।
একসময় আজিজের বিয়ে হয়ে যায় অদ্ভুতভাবে তাও গ্রামে নয়, শহরের সব থেকে সুন্দর এবং সবথেকে ভালো এক পরহেজগার নারীর সঙ্গে। মেয়েটা এমনই সুন্দর যে, বিয়েরপর আজিজ যখন তার স্ত্রীকে দেখেন, নিজের চোখে যেনো বিশ্বাস করতে পারেন না, ফলে নিজের অজান্তেই অজ্ঞান হয়ে যায়।
আজিজের বাবা একজন ব্যাক্তিকে সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন, সেই ব্যাক্তি প্রতিদানস্বরূপ আজিজের বাবাকে বলেন, আপনার কী কোনো ছেলে আছে? জবাবে আজিজের বাবা বলেন, হ্যাঁ আছে। কেনো? লোকটা বলেন, আমি আমার মেয়েকে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাই, যদি আপনি রাজি থাকেন। আজিজের বাবা বলেন, কিন্তু আমার ছেলে তো প্রতিবন্ধী। জবাবে লোকটা বলেন, তাতে কী হয়েছে! সেও তো মানুষ। ছেলের মনটা ভালো হলেই হবে। আজিজের বাবা খুশি হয়ে বাড়িতে ফিরে আজিজকে বললে আজিজ খুশি হয়ে যায়।
আজিজের বিয়ে হয়ে যায়, বিয়ের দিন রাতে মেয়েটার মন ভীষণ খারাপ হলেও তিনি সামলে উঠেন। এভাবে চলতে থাকে, কিন্তু এক পর্যায়ে গ্রামের অন্যসব দূরের মেয়েরা তার স্বামীকে নিয়ে কটাক্ষ করলে, তিনি তো প্রতিবন্ধী, এতো সুন্দর মেয়ে হয়ে প্রতিবন্ধীর সাথে কিনা বিয়ে হলো! যেমনটা আমাদের সমাজে হয়। আজিজকেও নানাজনে নানা কথা বলতো, তোর ভাগ্যে এতো ভালো সুন্দর মেয়ে জুটল! এক পর্যায়ে তিনি সহ্য করতে না পেরে তার স্ত্রী সহ আজিজ গ্রাম ছেড়ে শহরে পারি জমায়। যাওয়ার আগে তিনি একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেন, উল্লেখ্য আজিজ একেবারেই লিখতে জানতো না, শিক্ষক ইলমাজের চেষ্ঠার ফলে লিখতে শিখেন। এমনকি কিছু কিছু শব্দ উচ্চারনও করতে শিখেন। চিঠিটা ছেলে অনেকটা এমন...
বাবা আমার সালাম নিও। আপনারা আমাকে অনেক ভালোবাসেন, আমিও তোমাদের অনেক ভালোবাসি। আমার গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু গ্রামের মানুষরা আমাকে বুঝলোনা, আমি কি চাই। আমাকে ক্ষমা করিও। কোনো একসময় আমি আবার ফিরবো। আমার ঘোড়াটার যত্ন নিয়েন...
একসময় শিক্ষক মাহির ইলমাজের বিদায়ের সময় এসে যায়, বিদায়ের মূহুর্তটা ছিলো অদ্ভুত রকমের সুন্দর। আজিজের বাবা গ্রামের মাতব্বর। তার বাবা মাহির ইলমাজকে বলেন, তুমি আমার সপ্তম সন্তান। তিনি বাবা বলে তাকে জরিয়ে ধরেন। বিদায় নেন শিক্ষক মাহির ইলমাজ।
কেটে যায় ৭ বছর। মাহির ফিরেন তার স্ত্রী সহ হঠাত একদিন সেই গ্রামে। ততদিনে গ্রামের বেশ উন্নয়ন হয়েছে, রাস্তাও হয়েছে। তাদের গ্রামে প্রথম গাড়িতে আসে মাহির এলমাজ। প্রত্যেকে দেখে খুশিতে ভরে যায়। গাড়ি থেকে তার স্ত্রীও নামেন।
এক পর্যায়ে শিক্ষক এলমাজ বলেন, আপনাদের জন্য আমি একটা উপহার নিয়ে এসেছে, কী উপহার প্রত্যেকে দেখার জন্য আকুল হয়ে যায়। তখন গাড়ি থেকে নামেন আজিজ, তারপর তার ছেলে। ততদিনে আজিজ একেবারে সুস্থ হয়ে গেছেন, এরপরই তার স্ত্রী। তার স্ত্রীর কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। আজিজকে দেখে প্রত্যেকে হতভম্ব হয়ে যায়, প্রত্যেকে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। আজিজের বাবা তাকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, তুমি কি চিকিৎসা করেছো? আজিজ বলেন, না বাবা। তখন তার বাবা বলেন, সুস্থ কেমনে হলে বাবা? জবাবে আজিজ বলেন, আমি আমার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছি। স্ত্রীর ভালোবাসাই আমাকে সুস্থ করেছে বাবা।
এই মুভিটা আমি প্রায় ৫বারের মতো দেখেছি। কোনো মুভিই আমি একাধিকবার দেখতে পারিনা, কিন্তু এটা দেখেছি। মুভিটা ইউটিউবে রয়েছে, Mucize লিখে সার্চ দিলেই চলে আসবে ইংলিশ সাব টাইটেল সহ। এই মুভিটার দ্বিতীয় পার্ট আছে, সেই পার্টটা আজিজের শহরে পৌঁছে সেখানে কীভাবে সুস্থ হলে সেটা নিয়ে, সেটাও ইউটিউবে আছে।
,
রেটিংঃ এই মুভিটার রেটিং দেয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তবে বলবো, এই মুভিটা না দেখা মানে অনেক বড় কিছু মিস।
এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।