ব্যাংকের সুদ: হালাল নাকি হারাম? কুরআন ও হাদিসের আলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ

MD Nazir Hossain

July 14, 2025

✍️ হতে চান লেখক? উইব্লগবিডিতে এখন যেকেউ লিখতে পারবেন। রেজিস্ট্রেশন করুন

আধুনিক জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতিতে ব্যাংক একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সঞ্চয়, বিনিয়োগ বা লেনদেন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা ব্যাংকের উপর নির্ভরশীল। প্রচলিত ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা রাখলে নির্দিষ্ট সময় পর একটি অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া যায়, যা ‘সুদ’ বা ‘Interest’ নামে পরিচিত। কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক—ইসলামের দৃষ্টিতে এই ব্যাংক সুদ কি হালাল? নাকি হারাম?

আজকের এই আলোচনায় আমরা কোনো সাধারণ মতামত নয়, বরং কুরআন, হাদিস এবং ইসলামী ফিকহের আলোকে বিষয়টি গভীরভাবে জানার চেষ্টা করব।

‘রিবা’ বা সুদের পরিচয়

ইসলামী পরিভাষায় সুদকে ‘রিবা’ বলা হয়। ‘রিবা’ একটি আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হলো বৃদ্ধি, বা স্ফীতি। পারিভাষিকভাবে, কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়া ঋণের মূলধনের উপর অতিরিক্ত যে অর্থ শর্ত হিসেবে আদায় করা হয়, তাকে ‘রিবা’ বলে।

সহজ ভাষায়, কাউকে ১০০ টাকা ধার দিয়ে ফেরত নেওয়ার সময় কোনো ঝুঁকি বা শ্রম ছাড়াই পূর্বশর্ত অনুযায়ী ১০৫ টাকা আদায় করা হলে, এই অতিরিক্ত ৫ টাকাই হলো রিবা। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুদ ঠিক এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।

বিষয়টা আরও সহজভাবে বললে, কাউকে ১০০ টাকা দেয়ার বিনিময়ে তার থেকে ১০ টাকা লাভ নেয়া, হোক তার লাভ কিংবা লস, শর্ত হলো ১০০ টাকা দেয়ার বিনিময়ে তাকে ১০ টাকা সহ ১১০ টাকা ফেরত দিতে হবে। এটাই সুদ।

ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ইন্টারেস্ট বা সুদও এমনটাই, ব্যাংকের নির্দিষ্ট একটি সুদের হার থাকে, যেমন নির্দিষ্ট টাকা রাখা হলে তার বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ দেয়া হয়। এতে ব্যাংকের লাভ হোক বা লস, সুদ নির্দিষ্ট পরিমাণই দিতে হবে।

কুরআন ও হাদিসের কঠোর হুঁশিয়ারি
ইসলামে সুদকে শুধু অপছন্দনীয় বলা হয়নি, বরং এটিকে অন্যতম কঠোর কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

১. কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ:

পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সুদকে চূড়ান্তভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন।

“যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে। তাদের এই অবস্থার কারণ হলো, তারা বলে বেড়াত যে, ‘ব্যবসা তো সুদের মতোই’। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।”
– (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত ২৭৫)

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা:

সুদের ভয়াবহতা বোঝাতে আল্লাহ এর চেয়ে কঠিন ভাষা আর ব্যবহার করেননি।

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে, তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হয়ে থাকো। আর যদি তোমরা তা না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও।”
– (সূরা আল-বাকারাহ: ২৭৮-২৭৯)

“হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।”
– (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৩০)

২. হাদিসের কঠোর নিষেধাজ্ঞা:

রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদের সাথে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তির উপর অভিশাপ দিয়েছেন।

হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

“রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক এবং তার দুই সাক্ষীর ওপর অভিসম্পাত করেছেন। তিনি বলেছেন, (এই পাপে) তারা সকলেই সমান।”
– (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ১৫৯৮)

এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে, শুধু সুদ গ্রহণ করাই নয়, বরং সুদ দেওয়া, এর হিসাব লেখা এবং সাক্ষী থাকাও সমানভাবে অভিশপ্ত কাজ।

কেন সুদ হারাম? এর পেছনের কারণগুলো

ইসলাম একটি কল্যাণকামী ও ন্যায়ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা। সুদকে হারাম করার পেছনে গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক কারণ নিহিত রয়েছে।

অর্থনৈতিক শোষণ ও অবিচার:

সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় ঋণদাতা কোনো প্রকার ঝুঁকি বা শ্রম ছাড়াই অন্যের প্রয়োজন বা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিশ্চিত মুনাফা অর্জন করে। অন্যদিকে, ঋণগ্রহীতা তার ব্যবসা বা উদ্যোগে লাভ করুক বা ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তাকে সুদসহ আসল পরিশোধ করতেই হয়। এটি একটি চরম অর্থনৈতিক শোষণ।

সম্পদের অসম বণ্টন:

এই ব্যবস্থায় অর্থ কেবল ধনীদের হাতেই জমা হতে থাকে। ধনী ব্যক্তি তার অর্থ লগ্নি করে শ্রম ছাড়া আরও ধনী হয়, আর দরিদ্র বা উদ্যোক্তা ব্যক্তি ঋণের বোঝায় আরও জর্জরিত হয়। ফলে সমাজে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য পাহাড় সমান হয়ে ওঠে।

অলস ও অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি:

সুদভিত্তিক অর্থনীতি মানুষকে কর্মবিমুখ ও অলস করে তোলে। যাদের কাছে অর্থ আছে, তারা কোনো উৎপাদনশীল কাজে বা ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিতে চায় না, বরং বসে বসে সুদ গণনা করাকেই লাভজনক মনে করে।

সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্বের বিলোপ:

ইসলাম যেখানে মানুষকে পারস্পরিক সাহায্য ও সহানুভূতির শিক্ষা দেয় (করজে হাসানা বা উত্তম ঋণ), সেখানে সুদ এই মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়। এটি মানুষকে স্বার্থপর ও নির্দয় করে তোলে।

প্রচলিত ব্যাংক সুদ কি ‘রিবা’?

হ্যাঁ, প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান বা গ্রহণ করে, তা সর্বসম্মতভাবে ‘রিবা আন-নাসিয়াহ’র (ঋণের ওপর ধার্যকৃত সুদ) অন্তর্ভুক্ত এবং এটিই কুরআনে বর্ণিত হারাম রিবা। কারণ এখানে:

১. লাভের হার পূর্বনির্ধারিত।
২. আমানতকারী বা ব্যাংক কোনো ব্যবসায়িক ঝুঁকি নেয় না।
৩. সময় বাড়ার সাথে সাথে অর্থের পরিমাণ বাড়ে, যা কোনো বিনিময় বা উৎপাদন ছাড়া অর্জিত হয়।

বিকল্প পথ: ইসলামী ব্যাংকিং

সুদের এই ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে আধুনিক বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং একটি যুগান্তকারী ও সফল বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদের পরিবর্তে শরীয়াহসম্মত পন্থায় ব্যবসা করে। এর মূলনীতি হলো লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্ব।

কিছু জনপ্রিয় ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি হলো:

মুদারাবা (Mudarabah): এখানে গ্রাহক (সাহিব-আল-মাল) অর্থ বিনিয়োগ করে এবং ব্যাংক (মুদারিব) সেই অর্থ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। অর্জিত মুনাফা পূর্বনির্ধারিত হারে উভয়ের মধ্যে বণ্টিত হয়। লোকসান হলে তার দায়ভার গ্রাহক বা অর্থের মালিক বহন করেন।

মুশারাকা (Musharakah): এটি একটি অংশীদারি ব্যবসা, যেখানে ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়েই মূলধন বিনিয়োগ করে এবং চুক্তি অনুযায়ী লাভ-লোকসান ভাগ করে নেয়।

মুরাবাহা (Murabaha): কোনো পণ্য কিনে তার ক্রয়মূল্যের সাথে নির্দিষ্ট লাভ যোগ করে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা। এখানে মূল্য প্রথমেই নির্ধারিত থাকে, যা একটি বৈধ।

ইজারা (Ijarah): এটি অনেকটা ভাড়ার মতো। ব্যাংক কোনো সম্পদ (যেমন: গাড়ি বা বাড়ি) কিনে গ্রাহককে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ভাড়া দেয়।

বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিতে করণীয় কী?

অনেক সময় চাকরির বেতন, সরকারি ভাতা বা অন্য কোনো কারণে প্রচলিত ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা বাধ্যতামূলক হতে পারে। সেক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃতভাবে যে সুদ অ্যাকাউন্টে জমা হয়, তা নিয়ে কী করবেন?

ইসলামী স্কলারদের সর্বসম্মত মত হলো, এই সুদের টাকা কোনোভাবেই ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এটি অপবিত্র সম্পদ। এই অর্থ সওয়াবের নিয়ত ছাড়া শুধুমাত্র সম্পদকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে কোনো দরিদ্র, অভাবী বা জনকল্যাণমূলক কাজে দান করে দিতে হবে।

উপসংহার

উপরের কুরআন ও হাদিসের অকাট্য দলিল এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণ থেকে এটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, প্রচলিত ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত সুদ ইসলামে কঠোরভাবে হারাম। এটি এমন একটি পাপ যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।

একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো, এই ধ্বংসাত্মক পথ পরিহার করে হালাল উপার্জনের চেষ্টা করা। সৌভাগ্যক্রমে, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের সামনে একটি নিরাপদ ও শরীয়াহসম্মত বিকল্প রয়েছে। আসুন, আমরা আমাদের আর্থিক লেনদেনকে সুদমুক্ত করে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করি।

বই পড়ার অভ্যাস আমার সেই ছোট থেকেই, বই পড়তে ভালোবাসি আমি। এটা আমার নেশা। বই পড়ার মধ্য দিয়েই তো মানুষ আলোকিত হতে পারে। কাজেই আসুন বেশি বেশি বই পড়ি। বইয়ের আলোয় আলোকিত হই।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করার আগে খেয়াল রাখুন যেন ভদ্র ভাষা ব্যবহার করা হয়।