বই রিভিউঃ দেবী চৌধুরানী

Nir
0
বইয়ের নাম – দেবী চৌধুরানী
লেখক – বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়
বইয়ের ধরণ – উপন্যাস
 

ভূমিকাঃ

রংপুরের সত্য ঘটনা অবলম্বনে দেবী চৌধুরানী সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের শেষ দিকের একটি বিপুল জনপ্রিয় উপন্যাস। ১৮৮৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় ঐতিহাসিক এই উপন্যাসটি রচনা করেন এবং একই বছরে এটি প্রকাশিত হয় গ্রন্থ আঁকারে। তবে এই উপন্যাসের সাথে দেবী চৌধুরানীর বাস্তব জীবনী খুবই অল্প। লেখক নিজেই বলেছেন এমনটি। এটি যেনো কেউ ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে না ধরে শুধুই উপন্যাস হিসেবে পড়ার জন্য পাঠকের কাছে অনুরোধ করেছেন। কোনো একটি পোস্টে দেবী চৌধুরানীর ইতিহাস তুলে ধরবো ইনশা’আল্লাহ্‌।

পর্যালোচনঃ

দেবী চৌধুরানী তথা প্রফুল্লমুখী। উপন্যাসের শুরুতে প্রফুল্লমুখী ও তার মায়ের দারিদ্রতার অভাবে তিনি মায়ের কাছে না থাকার তাগিদ জাহির করেন। প্রফুল্লর বাবা বেঁচে নেই। প্রফুল্লের বিয়ে হয় বাল্যকালে। বরেন্দ্রভুমে ভূতনাথ (বর্তমানে ভূতছাড়া) নামের গ্রামের জমিদার হরবল্লভ বাবুর একটি মাত্র ছেলে ব্রজেশ্বরের সাথে। প্রফুল্লমুখী ব্রজেশ্বরের প্রথম স্ত্রী। কিন্তু বিয়ের পর কেউ কাউকে দেখে নি। তার আগেই গ্রামের মানুষের কাছে রটে যায় প্রফুল্লমুখী নাকি বাগদী ঘরের মেয়ে। যার দরুনে হরবল্লভ তাকে এ বাড়িতে তুলতে নিষেধ করে দেন। 
 
প্রফুল্লমুখীর অনুরোধে তার মা তাকে তার স্বামীর বাড়ি নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে তার তখন ও ঠাই হলো না। জমিদার হরবল্লভের ঐ এক কথা। কোনো বাগদী ঘরের মেয়ের এই বাড়িতে যায়গা নাই। প্রশ্ন করা হলে, সে কি করে খাবে প্রতি উত্তরে হরবল্লভ বলেন ‘প্রয়োজনে চুরি ডাকাতি করে খাক’। সেদিন রাত্রে প্রফুল্লর থাকার ব্যবস্থা হয়। তার মা বাহিরে অবস্থান করেন। প্রফুল্ল সাগরের সহযোগিতায় থাকতে পারেন। সাগর ব্রজেশ্বরের তৃতীয় স্ত্রী। তারই সহযোগিতায় ব্রজেশ্বরের সাথে দেখা হয়। সেই রাত্রে ব্রজেশ্বর তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সে বাবা ভক্ত। সে জানে;
“পিতা সর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্ব্বদেবতাঃ”
কাজেই সে সব কিছু ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু পিতাকে না। সেই রাতে ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে একখানা হার উপহার দেন। যাতে তা সৃতি হিসেবে থাকে। পরের দিন সকালে প্রফুল্লকে তার শশুরবাড়ি ত্যাগ করতে হয়। দিনকতক যাওয়ার পর প্রফুল্ল মাতৃহীন হয়ে যায়।
 
প্রফুল্লর পক্ষে একা রাত্রিযাপণ এক প্রকার ভঁয়ের কারণ হয়ে উঠলে তার মায়ের অনুগত ফুলমণিকে তার সাথে রাত্রিযাপনের অনুরোধ করেন। তিনি রাজী হয়ে যান। কারণ ফুলমণি বিধবা নারী, তাকেও একাই থাকতে হয়। কিন্তু ফুলমণি যে ছিলো ইতর জাতির মেয়ে, তা প্রফুল্ল জানতো না। ফুলমণির সাথে সেই গ্রামের জমিদার পরাণ চৌধুরীর গোমস্তা দূর্লভ চক্রবত্তীর বেশ মিল ছিলো। দূর্লভ চক্রত্তী এই খবর জানার পর তাকে কিছু দেয়ার শর্ত দিয়ে গভির রাতে ফুলমণির সহযোগিতায় ঘুমের মধ্যেই তাকে পালকিতে তুলে নিয়ে যায়। “এখানে বলা ভালো, সেকেলে রঙ্গপুর (বর্তমানে রংপুর) ছিলো বন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বাঘ ফাল্লুক সব প্রাণিই ছিলো রঙ্গপুরের জঙ্গলে। তার উপরে ডাকাতের উপদ্রব বেজায় ছিলো। সে সময় রঙ্গপুরের প্রথম কালেক্টর ছিলেন গুডল্যাড।” দূর্লভ ও ফুলমণি প্রফুল্লকে রাতের অন্ধকারে চুপি সারে সেখানকার জমিদার বাড়িতে যাওয়ার পথে সেখানে জঙ্গলে তারা দুজনের মানুষের কথা বলা দেখে ডাকাত মনে করে পাল্কি ফেলে দু’জনে দৌড়ে পালায়।
প্রফুল্ল জেগে উঠলে নিজেকে আবিষ্কার করে পালকিতে। পালকি থেকে বাহির হয়ে সেই পথেই চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ঘন জঙ্গলে দেখেন একটি ভবন। সেখানে প্রবেশ করলে চোখে পরে মৃত্যু শয্যায় শয্যায়িত এক বুড়ো। তার কাছ থেকে প্রফুল্ল শুনেন জীবন বৃত্তান্ত। সেই বৃদ্ধ তাকে কলসি ভর্তি মোহরের সন্ধান দেন। তাকে অনুরোধ করেন মরবার পর তাকে মাটি দিতে। সে মরে যায়। তাকে মাটি দেয় প্রফুল্ল।
 
সেই জঙ্গলেই প্রফুল্লর সাথে পরিচয় হয় এক ব্রাক্ষণ পণ্ডিতের সাথে। সেই ব্রাক্ষণ পণ্ডিত আর কেউ নয়, তিনি হলেন ভবানী পাঠক। সেই জঙ্গলের ডাকাতদের সর্দার। যার ভয়ে কাপে পুরো রঙ্গপুর। ইংরেজ কুল। ভবানী পাঠক প্রফুল্লর জন্য দুজন মেয়ে নিযুক্ত করেন তার সহযোগিতার জন্য। ভবানী পাঠকের উদ্যোগে প্রফুল্লকে শিক্ষা দান করা হয়। নানা ভাবে পুরো দশটি বছর চেষ্টা ও সাধনার ফলে প্রফুল্লকে দেবী চৌধুরানীতে রূপ দেন। ডাকাতদের সর্দার বানান। তার নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তার নাম শুনলে যে কেউ কেপে উঠে। “তারা ডাকাতি করে, কিন্তু তা ধনি ও দুষ্টু জমিদারদের সম্পদ লুট করে গরিবদের বিলিয়ে দেয়।”
 
ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচার ও ডাকাইতের অত্যাচারে ব্রজেশ্বরের বাবার জমিদারি ক্রমেই দেওলিয়া হতে ধরলে তার টাকার প্রয়োজন হয় অনেক। জমিদার হরবল্লভ তার ছেলেকে টাকা কোথায় ধার দেনা পাওয়া যায় সেখান হতে এনে দেয়ার তাগিদ হলে তিনি তা পালন করেন। নদীতে ব্রজেশ্বরের বজরা ডাকাতদলের হাতে বন্ধী হয়। বন্ধী করেন রঙ্গরাজ। দেবী চৌধুরানীর সহচর। তখন ব্রজেশ্বর কে দেবী চৌধুরানীর বজরায় নিয়ে গেলে তাকে চিনে ফেলেন। ব্রজেশ্বর তখন তাকে চিনতে পারে নাই। দেবী চৌধুরানী সব জানতো। তাকে পঞ্চাশ হাজার মুদ্রা ধার দেন। তা নিয়ে ব্রজেশ্বর তার বাবাকে সেটি দিলে তার জমিদারী বেঁচে যায়। কিন্তু টাকা ফেরত দেয়ার কোনো চিন্তাই তার ছিলো না। তার মতলব আলাদা। তিনি রঙ্গপুরে গিয়ে কালেক্টর সাহেবকে সব বললে পরিশোধের দিন কালেক্টর সাহেব সহ হরবল্লভ ও অনেক সৈন নিয়ে দেবী চৌধুরানীর বজরা আক্রমণ করলে সেখানে তার ছেলে ব্রজেশ্বর কে দেখে হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ব্রজেশ্বর জানতো না এই কারণেই তার বাবা রঙ্গপুরে গেছিলো। তখন দেবী চৌধুরানী ফন্দী আটেন। বেঁচে যায় কালেক্টরের হাত থেকে। কালেক্টর বন্দী হয় দেবী চৌধুরানীর হাতে। তখন জঙ্গলের মাঝে কালেক্টর সাহেবকে কিছু টাকা সহ ছেড়ে দেয়। দেবী চৌধুরানী ব্রজেশ্বরের সংসারে চলে যায়। ভবানী পাঠক ইংরেজদের হাতে নিজেই ধরা দেন। সমাপ্তি ঘটে তাঁদের ডাকাতদলের। তবে উপন্যাসের শেষটা মনোমুগ্ধকর। 
 

শেষ কথাঃ 

প্রতিটি পাঠকের এই বইটি পড়া উচিৎ। বঙ্কিমচন্দ্রের এই উপন্যাস অবলম্বনে ২০১৮ সালে স্টার জলসার জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ার হয়। ১৯৭৪ সালে দীনেন সেনদুপ্তের পরিচালনায় ‘দেবী চৌধুরানী’ মুভি নির্মাণ হলে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে গর্ম এই, এটি আমাদের রংপুরের ঘটনা। পীরাগাছার মন্থণায় তার জমিদার বাড়ি।

Post a Comment

0Comments

এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!