বড়দিনের বা ক্রিসমাস ডে'র কথা উঠলেই প্রথমেই আমাদের মনে যে গাছটির কথা উদিত হয়, সেটি হলো ক্রিসমাস ট্রি। এই গাছটি বড়দিন বা ক্রিসমাস দিনটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই গাছটি শুধু যে ইউরোপ-আমেরিকার মধ্যেই জনপ্রিয় তা নয় বরং এটি বাংলাদেশ কিংবা ভারত সহ সমগ্র বিশ্বেই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।
কিন্তু আমাদের অনেকের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, এই ক্রিসমাস ট্রি'র আগমন কবে ঘটলো? কেনোই বা একে ক্রিসমাস ট্রি বলে? এর গুরুত্বটাই বা কী? এর ইতিহাসটাই বা কী? এইসব প্রশ্নেরই উত্তর খুজবো আমরা।
খ্রিসমাস ট্রি হিসেবে যে গাছটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সেটি হলো ফার গাছ। এটি অনেকটাই দেবদারু গাছের মতো দেখতে লম্বা, পিরামিড মতো আকৃতির। সৌন্দর্যের দিক থেকে গাছটি দেখতে বেশ আকর্ষনীয়। এছাড়াও ঝাউ জাতীয় একধরনের গাছও ক্রিসমাস ট্রি বা বড়দিনের গাছ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ক্রিসমাস ট্রি হতে পারে সত্যিকারের আবার হতে পারে কৃত্রিমও। যেখানে এই গাছটির খোঁজ মিলে না সেই অঞ্চলে কৃত্রিমভাবে সাজানো হয় ক্রিসমাস ট্রি বা বড়দিনের গাছ। ক্রিসমাস ট্রিতে আলোর ব্যবহার ছাড়াও নানা অলঙ্কার দিয়েও সজ্জিত করা হয় এ গাছটি। এই গাছটির উপরে একটি তাঁরা ব্যবহার করা হয়, একে বলে স্বর্গদূত। এই স্বর্গদূতটি হলো বেথেলহামে জন্ম নেয়া যিশুখ্রিস্টের প্রতীক। বেথলেহাম হলো মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ইসরায়েল অধিকৃত ও ফিলিস্তিনি আরব অধ্যুষিত জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত অঞ্চলের একটি শহর।
কিন্তু ঠিক কবে ক্রিসমাস ট্রি বা বড়দিনের গাছটির আগমন ঘটে বা কিভাবে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয় বা উপহার দেয়ার শুরু কিভাবে এ নিয়ে রয়েছে নানা মহলে নানা বিতর্ক, তবে -এ নিয়ে নেই কোনো লিখিত প্রমাণ।
ইতিহাসের পাতা উলটালে দেখা যায় পনেরো শতকের শেষের দিকে ক্রিসমাস ট্রি ব্যবহার করা হয় প্রথমবারের মতো। তবে এটি আধুনিককালের হিসেব অনুযায়ী। এর আগে এই গাছটি কেমনভাবে ব্যবহৃত হতো তা নিয়ে নেই কোনো প্রমাণ। তবে যে ব্যবহৃত হতো এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একরকম তাঁরা নিশ্চিত, কারও দ্বিমত নেই। এক অংশ মনে করে ১৪৪১ সালে এস্টোনিয়ার তাল্লিনে প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো, আবার অন্য অংশ মনে করে ১৫১০ সালে লাটভিয়ার রিগায় প্রথমবারের মতো এই গাছটি সামনে আসে। প্রথম প্রমাণ্য এ নথি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। এখানে যে কোনটা সত্যি এ নিয়ে দণ্ড-বিতর্ক থাকলেও এখানেই যে ক্রিসমাস ট্রি বা বড়দিনের গাছের উৎপত্তি তা নিয়ে নেই কোনো বিতর্ক। এখান থেকেই মূলত ক্রিসমাস ট্রি'র জনপ্রিয়তার সূত্রপাত ঘটে, এটাই বিশ্বাস করা হয়।
ক্রিসমাস ট্রি বা বড়দিনের গাছ সম্পর্কে রয়েছে লোকমুখে নানা গল্প। তারমধ্যে একটি হলো,
শীতের সময়। রোমের এক কাঠুরের ঘরে আগমন ঘটে এক আগন্তুক শিশুর। কাঠুরের দম্পত্তি ছিলো অধিক পরিমাণে যিশু ভক্ত, ধার্মিক। তাঁরা শিশুটিকে আদর করে খাওয়ালেন এবং নরম বিছানায় শুতে দিলেন। পরদিন সকালে ওই শিশুটি ঘুম থেকে উঠে দেবদূতের রূপ ধরে বললে, আমিই যিশু। তাকে আদর আপ্যায়ন করার দরুন কাঠুরে দম্পত্তিকে তিনি একটি গাছের ডাল দিলেন এবং সেটি মাটিতে পুতে রাখতে বললেন। কাঠুরে দম্পতি তাই করলেন। দেখা গেলো ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন বা ক্রিসমাস আসতেই গাছটি সোনালী আপেলে ভরে গেছে। তখন তাঁরা সেই গাছটির নাম রাখলেন, ক্রিসমাস ট্রি।
আরেকটা গল্প রয়েছে ক্রিসমাস ট্রি'র আগমন নিয়ে, সেটি অনেকটা এমন,
একবার এক গরীব শিশু গির্জায় গিয়ে সেই গির্জার মালিকে কিছু পাইন গাছ দেয়ার বিনিময়ে তাকে কিছু টাকা দিতে বলল। মালি কিছু টাকার বিনিময় সেই গরীব শিশুর থেকে গাছগুলো নিয়ে গির্জার পাশে পুতে দিলো। ২৫ ডিসেম্বর আসতেই ক্রিসমাস বা বড়দিনের দিন ওই গির্জার মালি ঘুম থেকে উঠে গাছগুলির দিকে তাকাতেই অবাক বনে গেলেন। গাছগুলি একেবারে গির্জার থেকেও বড় হয়ে গেছে! শুধু কি তাই, গাছগুলো থেকে ঝরে পড়ছে অজস্র তারার আলো। তখন সেই মালিটি সেই গাছটির নাম রাখলেন, ক্রিসমাস ট্রি।
খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস অনুসারে ক্রিসমাস ট্রি'র ঐতিহ্য জড়িয়ে রয়েছে জার্মানির গেইসমার শহরের এক সাধুর সঙ্গে। নাম তার সেইন্ট বনিফেস, জন্ম ৬৭২ এবং মৃত্যু ৭৫৪। তিনি মূলত সেখানে একটি প্রাচীন দেবদারু জাতীয় ফার গাছ বেড়ে উঠতে দেখেন। তিনি এই গাছটি দেখার পর উপলব্ধি করেন এটিই যিশুখ্রিস্টের প্রতীক। তিনি তখন এই গাছটিকে যিশুখ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাসের চিহ্নরূপে সর্বমহলে প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে সেই ফার গাছটিকেই ক্রিসমাস ট্রি বলা হয়ে থাকে। এবং এ কারনেই সেইন্ট নিকোলাসকে বলা হয় সান্তা ক্লজ।
সান্তা ক্লজ বলতে আমরা যে মানুষটিকে মনে করে থাকি, সেটি হলেন সেইন্ট নিকোলাস। তিনি ছিলেন একজন ধর্মযাজক। তিনি ফাদার ক্রিসমাস নামেও পরিচিত।
Read More:
যেসকল দেশে গ্রীষ্মকালে ক্রিসমাস উৎসব পালন করা হয়
শুধু যে ক্রিসমাস ট্রি বাইরেই সাজিয়ে রাখা হয় তা নয়, ঘরের ভিতরেও ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে রাখা হয়। প্রথম দিকে ঘরে ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে রাখার প্রথাটি ছিলো না, তখন যা হতো সব খোলা আকাশের নিচে সজ্জিত করা হতো। ১৬ এর দশক থেকে প্রথমবারের মতো জার্মানিতে ঘরের ভিতর ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রথাটি চালু হয়। ঘরের মধ্যে ফার গাছ এনে সেটাকে আলো ও নানা অলঙ্কার দ্বারা সজ্জিত করে ঘরের মধ্যেই পালন করা হতো ক্রিসমাস ডে বা বড়দিন। অনেক সময় কৃত্রিম গাছ দ্বারাও করা হয়। তারপর থেকে ধিরে ধিরে চারদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকে এই প্রথাটি। আমেরিকায় এই প্রথাটি প্রবেশ করে আরও দুইশত বছর পর তথা আঠারোশ শতকের দিকে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, ক্রিসমাস ট্রি ইংল্যান্ডে আগমন ঘটে অনেক পরে তথা উনিশ শতকের দিকে। খুব বেশি আগে না। কিন্তু ইংল্যান্ডে কেনো এতো দেরিতে প্রবেশ করলো তা জানা যায়না। তবে ইংল্যান্ডে প্রবেশের পর খুব দ্রুতই সমগ্র ইংল্যান্ড জুরে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করলো। এখন তো এটি ইউরোপ আমেরিকার গণ্ডি পেড়িয়ে বর্তমানে এটি সমগ্র বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বেশ জনপ্রিয়।
তবে ইংল্যান্ডে ক্রিসমাস ট্রি অনেক পরে প্রবেশ করলেও, যখন ইংল্যান্ডে প্রবেশ করলো, তখন থেকে সমগ্র বিশ্বে দ্রুত প্রবেশ করতে শুরু করে ক্রিসমাস ট্রি। ক্রিসমাস ট্রি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে সম্পূর্ন ভূমিকা রয়েছে যুক্তরাজ্যের সেসময়ের রাণী ভিক্টোরিয়ার। তার স্বামী ছিলেন জাতে জার্মানী। একদিন তিনি তার স্বামীকে বললেন, ছেলেবেলায় বড়দিনে গাছ যেভাবে সাজানো হতো সেভাবেই যেনো এবারও গাছ সাজানো হয়। তখন ১৮৪৮ সাল শেষের দিকে বড়দিনের কিছু আগে। রাণী ভিক্টোরিয়ার স্বামীর নাম ছিলো প্রিন্স আলবার্ট। প্রিন্স আলবার্ট সেবার সবুজ একটা গাছকে জার্মান স্টাইলে বিভিন্ন মোমবাতি, মিষ্টি ও অলঙ্কার দিয়ে সাজালেন। সেটিই ছিলো ইংল্যান্ডে প্রথমবারের মতো ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রথা। সেই গাছটি সাজানোর পর সেই গাছের ছবি ফিচার হয়ে যায় লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায়, ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। তখন শুরু হলো বিভিন্ন মহলে ক্রিসমাস ট্রি বা বড়দিনের গাছ সাজানোর প্রতিযোগিতা। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য মূলত চারটি দেশ নিয়ে গঠিত তথা ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডস।
ক্রিসমাস ট্রি'তে মোমবাতির আলোর পরিবর্তে টমাস আলভা এডিসনের সহযোগী এডওয়ার্ড জনসন ক্রিসমাস ট্রি'তে বৈদুতিক আলোর ব্যবস্থা করে ফেলেন। এরপর থেকে মোমবাতির আলোর পরিবর্তে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার প্রথমবারের মতো শুরু হয়।
Read More:
বড়দিনের ইতিহাস - যেভাবে পালিত হয় বাংলাদেশে ক্রিসমাস
যুক্তরাষ্ট্রের ২৩ তম প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন হ্যারিসনের আমলেই ১৮৮৯ সালে প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউজে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়। এরপর থেকে যতই দিন অতিবাহিত হতে লাগলো, ততই ক্রিসমাস ট্রি বা বড়দিনের গাছ সর্বজগতে মূল আকর্ষন ও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো।
এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।