গল্পের নামঃ বৃদ্ধাশ্রম
লেখকঃ নাজির হোসেন
গল্প - বৃদ্ধাশ্রম |
মতিন সাহেব নিজেকে মনে করেন তিনি একজন সচেতন পিতা। তার একটি মাত্র সন্তান নাম আরিফ। মতিন সাহেবের ইচ্ছা তার সন্তান'কে তিনি বড় একজন প্রকৌশলী বানাবে বানাবে। প্রত্যেক পিতারই অনেক স্বপ্ন তাদের সন্তান'কে নিয়ে। তিনি তার সন্তান'কে সব সময় আদর করেন আর এজন্যই তার সন্তান যা চায় তাই দেন।
মতিন সাহেব তার ইজিচেয়ারে বসে চা খাচ্ছে, এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই হুট করে মতিন সাহেবের কাছে আসে আরিফ, তার বাবা'কে বলেন;
'বাবা এক হাজার টাকা দাওতো'
মতিন সাহেব কারণ জানতে চেয়ে বলেন;
'কেনো? এতো টাকা কি করবি।'
'দরকার আছে'
তিনি তার পকেট থেকে এক হাজার টাকার চকচকে একটা নোট বাহির করে দিলেন তার সন্তানের হাতে। আরিফ টাকা হাতে পেয়েই তার বাবা'কে ধন্যবাদ বলে দিলেন এক ছুট বাসার বাহিরে।
মতিন সাহেবের মতে সন্তান টাকা চেতেই পারে। তার দরকার থাকতেই পারে। এজন্য যে তাকে টাকা দেয়া যাবে না তা নয়। এই বয়সে বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা না দিলে কি হয়! ছেলে বাহিরে যাই করুক, নিশ্চয়ই ভালো কিছু করবে। মন্দ কিছু অন্তত তার সন্তান করবে না। এ বিশ্বাস মতিন সাহেবের ভালোভাবেই আছে।
মতিন সাহেবের একটা বড় গুণ হলো তিনি তার সন্তান'কে কখনোই ধর্মীয় শিক্ষা দেন না। তার ধারনা ধর্মীয় শিক্ষা দিলে তার সন্তান জঙ্গি হয়ে যাবে। ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস জন্মে যাবে। মতিন সাহেব আরিফ'কে সবসময় অনেক বড় বড় আবিষ্কার সম্পর্কে বলেন, নানান বৈজ্ঞানিক এর জীবনী শোনান। প্রাচিন কাহিনি শোনান। অনেক গল্প শোনান তার সন্তান'কে মতিন সাহেব। নানান স্বপ্ন দেখান। তবে তিনি নৈতিকতার শিক্ষা খুব বেশি একটা দিতেন না, ভাবতেন বর্তমান দুনিয়ায় নৈতিকতার মূল্য নাই।
একবার আরিফ তার এক বন্ধুর কাছ থেকে একখানা ধর্মীয় বই নিয়ে এসেছিলো। তার বন্ধু তাকে বইটা উপহার দিয়েছিলো। মতিন সাহেব তার ছেলের হাতে ধর্মীয় বই দেখে শ্রেফ বলে দিয়েছিলো যে আর কখনোই যেনো সে কোনো ধর্মীয় বই না আনে এবং না পড়ে। ধর্মীয় বই পড়ে কি তুই জঙ্গি হতে চাস? গোলাগুলি করতে চাস?
সেদিনের পর থেকে আরিফ কারো থেকে কোনো ধর্মীয় বই নেন না এবং পড়েন ও না। সে ছাত্র হিসেবে খারাপ নয় বরং ভালো। আর এ কারনেই তার বাবা-মা তার প্রতি খুব খুশি। কারন তার ছেলের গ্রেড পয়েন্ট সবসময় ভালো করেন। ক্লাসে প্রতি পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে।
এভাবে কেটে গেলো দশ বছর। আরিফ এখন আর ছোট নয়। অনেক বড় হয়েছে। চাকরি হয়েছে। বিয়ে করেছে। আলাদা একটা সংসারও হয়েছে তার। এখন আর তিনি দেশে থাকেন না, থাকেন বিদেশে।
অপরদিকে মতিন সাহেবের বয়স হয়েছে অনেক। বৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। তাকে দেশেই থাকতে হয়। দেশে তার কেউ নেই। স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, সে গতবছর গত হয়েছে। তাই তাকে থাকতে হয় একা। তার একটি মাত্র সন্তান। সে তো দেশে থাকেন না। থাকেন বিদেশে। পাশ্চাত্যের উন্নয়নশীল একটা দেশে অনেক বড় পোষ্টে চাকরি করেন তিনি।
মতিন সাহেবের যে ইচ্ছা ছিলো তা পূর্ণ হয়েছে৷ তিনি তার সন্তান কে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চেয়েছেন, অনেক কষ্টে তার সন্তান এখন বড় একজন তরিৎ প্রকৌশলী হয়েছে।
মতিন সাহেবের চাকরির বয়স শেষ। তিনি এখন অবসরে থাকেন। সংসার তাকে অনেক কষ্টে চালাতে হয়। তার ছেলে তাকে কোনো টাকা পাঠান না। তিনি নাকি যে মাইনে পান, তা দিয়ে তার সন্তানের চলে না। তাছাড়া বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো নাকি অনেক ঝামেলা।
হঠাৎ করে আরিফ একদিন তার বাবা'কে ফোন দিয়ে বলে;
'বাবা কেমন আছো?'
মতিন সাহেব তার সন্তানের ফোন পেয়ে খুশি হয়ে উত্তর দেয়;
'ভালো আছি বাবা, তুমি?'
'আমিও আছি, ভাবতেছি দেশে ফিরে তোমাকে নিয়ে আসবো এখানে।'
ঈদের সময়, মতিন সাহেবের ছেলে তার বউ ও নাতি এসেছে দেশে। বহুদিন পর। সর্বশেষ এসেছিলো পাচঁ বছর আগে। তখন মতিন সাহেবের স্ত্রী বেচে ছিলো। মারা যাওয়ার সময় আরিফ ব্যাস্ততার কারনে আসতে পারে নাই তার মা'কে দেখতে।
মতিন সাহেব থাকেন একা বাড়িতে। কাজের লোক থাকে একজন। ছেলে, বউ ও নাতি আসায় তাদের বাড়িতে কয়েকদিন কেটে গেলো বেশ আনন্দে। তার ছেলেকে ফিরতে হবে বিদেশে। ছুটি প্রায় শেষের পথে। কাজেই খুব তারাতারি তার ছেলে আরিফ'কে পাসপোর্ট ভিসা করতে হলো তার বাবা'র জন্য। মা বেচে থাকলে ভালোই হতো। তাকেও দেখানো যেতো বিদেশ। তার বাবা যাচ্ছে তাদের সাথে। দেশের এই বাড়ি'টা বিক্রি না করে অন্যের হেফাজতে রেখে চলে গেলো বিদেশে তারা সবাই।
অপরিচিত একটি দেশ। মানুষের পোশাক, কথাবার্তা, চেহাড়া একদম ভিন্ন। আবহাওয়া ভিন্ন। অনেক ঠান্ডা। মতিন সাহেব ইংরিজি খানিকটা বুঝেন, কিন্তু বলতে পারেন না। বাংলাদেশের ইংরেজি আর ব্রিটিশ'দের ইংরেজি'র মধ্যে অনেক ভিন্নতা। একটি শব্দের মধ্যে, অনেক কিছু বর্ণমালা ব্রিটিশ'রা উচ্চারণ করেন না, সেগুলো সাইলেন্ট ভাবে উচ্চারন হয় যেমন "আ'র"। এদেশের মানুষের মাতৃভাষা ইংরেজি। সাদা মানুষের কোনো অভাব নেই, অভাব শুধু কালো মানুষের।
মতিন সাহেব তার নাতি'টাকে খুব আদর করেন। সারাদিন নানু নানু করে ডাকেন তাকে তার নাতি'টা। কি যে ভালো লাগে মতিন সাহেবের! তার নাতিটা সবে হাটতে শিখেছে, ভাংগা ভাংগা কন্ঠে কথা বলতেও শিখেছে বৈকি।
বিদেশে ছেলে-বউ এর কাছে কেটে গেলো প্রায় আধা বছর। এখন আর আরিফের স্ত্রী'র সহ্য হয় না তার বাবা এখানে থাকা'কে। একদিন সোবার ঘরে আরিফের স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করলো;
'তোমার বাবা-মা কি সারাজীবন এখানে থাকবে?'
আরিফ অবাক হয়ে উত্তর দেয়;
'হ্যা, তাতে তোমার কোনো সমস্যা?'
'সমস্যা তো অবস্যই, তাকে আমার সহ্য হয় না'
'কী করতে বলো তাহলে আমাকে?'
'তুমি তাদের'কে দেশে রেখে আসো'
'সেটা এখন সম্ভব নয়'
'তাহলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসো।'
আরিফের মনে ধরে গেলো তার স্ত্রী'র কথা। তারও তার বাবা'কে ইদানিং সহ্য হয় না। তাই সে ডিসিশন নিয়ে নিলো তার বাবা'কে বিদ্যাশ্রমেই রেখে আসবেন।
সেই দিনটি ছিলো রবিবার। ব্রিটেনে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকালে ব্রেক ফার্স্টের সময় আরিফ তার বাবা'কে বললো;
'বাবা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে'
মতিন সাহেব মাথা ঘুরিয়ে আরিফের দিকে তাকিয়ে যানতে চায়;
'কি কথা?'
'এখানে একটু সমস্যা হয়েছে, তাই আমি চাচ্ছি তোমাকে আপাতত বিদ্যাশ্রমে রাখতে।'
মতিন সাহেব তার ছেলের কথা শুনে অবাক বনে গেলেন। তার নিজের ছেলে কিনা বলে তাকে বিদ্যাশ্রমে থাকতে হবে! সমস্যা যতই থাকুক। সমস্যা'র সাথে এর কি সম্পর্ক। বিদ্যাশ্রমে থাকলে সমস্যা সমাধান হবে! তিনি কোনো কথা বললেন না। আরিফ ফের বললো;
'আমি কালকে তোমাকে রেখে আসবো। আবার কিছুদিন পর নিয়ে আসবো।'
মতিন সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে বললেন;
'তোমার যদি এটাই করলে ভালো হয়, তাহলে তাই করো।'
পরের দিন সকাল বেলা। আরিফের স্ত্রী ঘুম থেকে উঠেই তার শশুরের কাপড়চোপড় গোছানো শুরু করে দিয়েছে। তার মতে আজকে থেকে আপদ বিদায় হবে।
সকালের নাস্তা সেড়ে আরিফ তার বাবা'কে রেখে আসলেন অপরিচিত আরেক জায়গায়। যেখানে শুধু অসহায় বাবা-মায়েরাই থাকেন। সেই বৃদ্ধাশ্রমে।
মতিন সাহেব চার দেয়ালে ঘেরা বিদ্যাশ্রমে থাকেন, আর ভাবেন হয়তো একদিন তার ছেলে আসবে। এসে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে।
তার মনে পড়তে থাকে সন্তান'কে মানুষ করার সেই দিনগুলি। তার সন্তান যা চেয়েছে তাই তিনি দেয়ার চেষ্টা করেছো। সবসময় আদর করেছে।
মতিন সাহেব বুঝতে পারে, তিনি সন্তান আদর করে লক্ষীটি বানাতে পারেন নি, বানিয়েছেন বাদর। নৈতিকতার শিক্ষা কখনো দেয়া হয়নি আরিফ'কে। ধর্ম থেকে সরিয়ে রেখেছেন তিনি। তার মনে পড়ে যায় স্যার স্ট্যানটি'র সেই চিরন্তন সত্য মহা উক্তিটি
'তুমি যদি তোমার সন্তান'কে পড়া, লেখা, গনিত, বিজ্ঞান শেখাও কিন্তু ধর্ম থেকে দূরে সরে রাখো তাহলে তুমি গর্ধবেই পাবে'
তিনি ভাবেন, আর অনুতপ্ত হন। আহারে, ছেলেটা তার নিজের দোষের কারনে নষ্ট হয়ে গেলো৷ এমন শিক্ষা অর্জন করলো, যার কোনো মূল্যই নেই।
- নাজির হোসেন (বৃদ্ধাশ্রম)
১০/০১/২০২০
এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।