লেখকঃ নাজির হোসেন
সীতাকুণ্ডে গিয়েছি ঘুরতে। সবাই যায় দলবেধে, আমি গিয়েছি একা পথে। সীতাকুণ্ডের প্রকৃতি, ভারি সুন্দর। কত যে ভালো লাগে। যেদিকে চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়।
দিনটা ছিলো সোমবার। শীতের শেষের দিকে। আমি চন্দ্রনাথ পাহাড় ঘুড়ে
গ্রাম দেখতে বেড়িয়েছি। পাহাড়ি গ্রামগুলো দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে। এখানে
বাঙ্গালিদের পাশাপাশি ত্রিপুরা'রা বাস করে। ত্রিপুরা'রা পাহাড়ে বেশিরভাগ তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করে।
তাদের গ্রামীণ জীবন অনেক সুন্দর। আমি যখন কাচা পথ'টা দিয়ে হাটছিলাম, তখন চোখে পড়লো নানান সব
জায়গা। পথের একধারে পুকুর। পুকুরে পানি খুবই কম। শীতের শেষের দিকে, বৃষ্টি নেই, পানি তো কম থাকবেই।
গ্রামের ছেলেরা ছোটাছুটি করছে, মেয়েরা
বুড়ি ছি খেলছে। যারা বয়স্ক তারা তাদের কর্ম নিয়ে ব্যাস্ত। এই গ্রামের মানুষ'দের প্রায় প্রতেকেরই বাড়ির আঙ্গিনায় নানান সব ফুলের গাছ। যা আমার খুবই
ভালো লেগেছিলো। আমি ভাবতাম, আগের মতো হয়তো এখনকার
ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলা হয়তো করে না। এখানে এসে হল তার উল্টো, কয়েক'টা ছেলে সাইকেলের টায়ার চালাচ্ছে আর
দৌড়াচ্ছে, তাদের লক্ষ কে আগে যায়। মাঝে মাঝে বুম বুম ও
করছে, এই বুঝি তাদের গাড়ি'র
গতিবেগ বেড়ে গেলো।
একটু সামনে একটা ছোট খোলামাঠ, সেখানে
চোখে পড়লো কয়েকজন খেলছে। ক্রিকেট খেলছে। অনেকদিন ধরে ক্রিকেট খেলা হয় না, ঠিক কতদিন তা আমার জানা নেই। খেলতেও ইচ্ছে করে ছিলো তাদের সাথে,
না খেলে দর্শক হয়ে তাদের খেলা দেখলাম কিছুক্ষন।
ক্রিকেট খেলা শেষে সবাই যখন বাড়িতে যাবে, তখন রাস্তার ধারে ছোট একটা গাছের ডালে বসে একটা ছেলে পা নাচাচ্ছে। গানও জুড়েছে। আমিও গেলাম তার কাছে, ডাল'টা নিচে হওয়ায় চড়তে কোনো সমস্যা হলো না। আমি অবশ্যি গাছে উঠতে পারি না। চেষ্টা করলে এখনো শিখতে পারবো, কিন্তু সে বয়স হয়তো শেষ।
ছেলেটা আমাকে দেখে গান করাও বন্ধ করে দিলো, পা নাচাও বন্ধ করে দিলো। আমি বললাম;
- গান যে বন্ধ করে দিলে। গাও গাও, তোমার গলা'তো ভারি মিষ্টি। তোমার গান শুনতেই এলাম।
ছেলেটা বললে;
- আমি যে গান পারিনে।
- তাহলে একটু আগে কি গাইলে?
- একটাই গান শুধু জানি।
- তাই গাও তাহলে।
ছেলে'টা গান গেতে শুরু করে দিলো। আমিও শুনতে লাগলাম।
দূর পাহাড়ের ওই গায়ে
ছোট্ট একটা মেয়ে থাকে
পরিচয় তার রাখালের সাথে
বিয়ে হয়েছে তার সাথে
তার গান শুনছি আর চারিদিকের প্রকৃতি অনুভব করছি। সামনে তাকালেই চোখে পড়ে পাহাড় সাড়ি। কতদূর আর! একটা দৌড় দিলে পাচ মিনিটেই পাহাড় কন্যাদের কাছে যাওয়া যাবে। তার গান শেষ হওয়ায় আমি বললাম;
- তোমার গলাটা সত্যি চমৎকার। তুমি অনেক বড় শিল্পি হতে পারবে বড় হয়ে।
ছেলেটা কোনো কথা বললো না, মাথা নিচু করে থাকলো। আমি বললাম;
- নাম কি তোমার?
- নিরব।
- খুব সুন্দর নাম তো। তোমার বাবা কি করে?
- বাবা তো বেচে নেই, আমার জন্মের পর মারা গেছে। এখন মা আছে।
শুনে খুব খারাপ লাগলো। বাবা নেই। দুনিয়াতে সন্তানের জন্য বাবা হলো মর্যাদার দিক দিয়ে সবার উপরে। তার বাবা নেই।
আমি জানতে চাইলাম;
- তুমি পড়ালেখা কর না?
সে মাথা নেড়ে বললে;
- হ্যা করি।
- কোন ক্লাসে?
- তৃতীয় শ্রেণীতে।
- তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?
- ডাক্তার। ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবো।
- ভেরি গুড। কিন্তু তোমাকে ভালোভাবে লেখাপড়া করতে হবে। জানতে হবে অনেক। মনে রাখবে, পড়ালেখা জানার জন্য। চাকরি পাওয়ার জন্য না।
- কিন্তু আমাদের যে অত টাকা নেই। আমরা যে খুব গরিব মানুষ। পড়ালেখা করতে তো অনে___ক টাকা লাগে।
- তুমি কি জন্য আছো। তুমি নিজে জমাতে পারবে না? প্রয়োজন হলে কাজ করবে। সেই টাকা দিয়ে পড়ালেখা করবে। মনে রাখবে, পড়ালেখা করে যে জ্ঞানীগুণী হয় সে।
ছেলেটার অনেক স্বপ্ন। সাধারণত যাদের সামর্থ্য কম স্বপ্ন পূরণের, তাদেরই স্বপ্ন বেশি। আর যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের স্বপ্ন কম।
এদিকে বেলা গরিয়ে এলো, সূর্য পশ্চিমে অস্ত যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আমার আর এখানে থাকা চলে না, ফিরতে হবে চট্রগ্রামে। ছেলেটাকে বললাম;
- আমি এখন চলে যাবো, আবার আসবো, দেখা হবে নিশ্চয়ই।
ছেলেটা মাথা নেড়ে হ্যা সম্মতি দিল। আমি বললাম;
- তুমি রিডিং পড়তে যানো?
- হ্যা জানি।
- তাহলে আমি তোমাকে কিছু বই দিচ্ছি নিয়ে যাও, বাসায় পড়িও।
সীতাকুণ্ডের পথে পথে পর্ব - ১ পড়ুন;
সীতাকুণ্ডের পথে পথে (পর্ব ১)
আমার ব্যাগে একটা গল্পের মোটা বই ছিলো। সেটাই দিয়ে দিলাম। আর
একটা কিশোর উপন্যাস ও সাথে দিলাম। যদি আগে জানতাম, তাহলে
গ্রাফিক্স করা ছবিওয়ালা বই এনে দিতাম। যাকগে, এরপর তো
আবার আসবো। প্রতি বছরেই আসা হবে চট্রগ্রামে যতদিন ভাই থাকে। তখন না হয় দেয়া যাবে।
ছেলেটা বই পেয়ে যা খুশি। ওর খুশিতে আমার ভিতরটাও যেনো গুলিয়ে
এলো।
সে একটু হেসে বললে;
- আচ্ছা আমি যাই। মা বকবে।
বলেই দিলো এক ছুট। এক দৌড়ে বাড়ি পৌছেছে হয়তো। আমি নির্বাক হয়ে
পথের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
- ভ্রমণঃ সীতাকুণ্ডের পথে পথে (পর্ব-২)
২০/০৫/২০২০
এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।