ছবিঃ বিরিশিরি |
বিরিশিরি বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এটি বাংলাদেশের সুন্দরতম গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। বিরিশিরি এর মূল আকর্ষণ বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড়, যার বুক চিরে বয়ে চলেছে নীলচে সবুজ পানির হৃদ। মাটির রঙটা বেশ সুন্দর, সাদা, তাই তো একে সাদা মাটির পাহাড় ও বলা হয়। সাদা মাটির রঙ যেনো নীলচে পানির রঙকে আরও নীলাভ করে তুলেছে। এখানে যে শুধু চীনামাটির পাহাড় ও নীলচে পানির হৃদ রয়েছে তা নয়, বিরিশিরিতে রয়েছে আরও বেশ কিছু জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। তাই ভ্রমণপ্রিয় ব্যাক্তিদের কাছে বেশ পছন্দের একটি গন্তব্যস্থানগুলির মধ্যে বিরিশিরি অন্যতম।
সেন্টমার্টিনের নীল পানি কিংবা জাফলং এর মনমাতানো স্বচ্ছ পানির স্রোত হয়তো সবাই দেখেছেন। কিন্তু সবুজ নীলের মিশেলে অদ্ভুত সুন্দর বর্ণে বর্ণিল পানি কখনো দেখেছেন? হয়তো দেখেছেন অথবা না। যদি না দেখে থাকেন তবে চলে আসুন বিরিশিরিতে। তবে বিরিশিরিতে আসলেই যে এ দৃশ্য দেখতে পারবেন তা নয়, যেতে হবে বিরিশিরি থেকে কিঞ্চিৎ দূরে বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড়ে। বিরিশিরি চীনামাটির পাহাড় ও নীলাভ পানির হৃদ বিরিশিরির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়।
বিরিশিরির বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড় ও আশপাশের সমভূমি সহ এর দৈর্ঘ মোটের উপর প্রায় ১৬ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৬০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
কর্মব্যস্ততার দরুন অনেকে সময় নিয়ে লং ট্রিপে ভ্রমণে যেতে পারেন না। ফলে একদিনে দূরের ভ্রমণ গন্তব্যের খোঁজ করেন। তাদের জন্য দূর্গাপুরের বিরিশিরি উত্তম একটি স্থান। বিরিশিরি আপনি একদিনে একদম কম খরচে ভ্রমণ করতে পারবেন। এটি একদিনে অল্প খরচে ভ্রমণের একটি জনপ্রিয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বিরিশিরির চীনামাটির পাহাড়ে যখন পৌঁছুবেন, তখন এর চারদিকের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করে দিবে। ভুলিয়ে দিবে সব ব্যস্ততা। এই হৃদের নীল পানির অপরূপ সৌন্দর্য আপনার সমস্থ ক্লান্তি দূর করে দিবে নিমিশেই। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবেন এর অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে, ঠিক যেমনটা একজন মানুষ তার প্রিয় মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই হৃদের অপরূপ নীল পানির উৎসস্থান সমেশ্বরী নদী। এটি বর্তমানে কয়লা খনি হিসেবে পরিচিত।
বিরিশিরির চীনামাটির পাহাড় ভ্রমণে নিজের জীবনসঙ্গীকে নিয়ে যেতে ভুলবেন না যেনো। প্রিয় মানুষটার সাথে উপভোগ করতে পারেন অপরূপ প্রকৃতির বাহারি রূপ। এর সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করে দিবে - মাতাল করে দিবে। আপনার মনকে ভরিয়ে দিবে প্রশান্তিতে।
বিরিশিরিতে যা যা দেখবেন
বিরিশিরিতে চীনামাটির পাহাড়, নীল পানির হৃদ ছাড়াও রয়েছে সোমেশ্বরী নদী, কমলা রাণীর দিঘি, রানীখং গির্জা। এছাড়াও এখানে রয়েছে হাজং মাতা রাশিমনি সৃতিসৌধ যা বিজয়পুর যাওয়ার মধ্যেই পরবে। এটি কামারখালি বাজারের পাশেই বহেরাতলীতে অবস্থিত।
এছাড়াও এখানে রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, এখানে সংরক্ষরিত রয়েছে এ অঞ্চলে বসবাসকৃত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জীবনযাত্রা। দূর্গাপুরের জমিদার বাড়ি। গারো, হাজং ইত্যাদি উপজাতিদের বসবাস। রয়েছে কংশ নদী, আত্রাখালি নদ।
বর্ষাকালে বিরিশিরির রূপ সৌন্দর্য অনেক গুণ। তখন সোমেশ্বরী নদীতে পানি থাকে অথৈই। দূরের পাহাড়গুলি হয়ে ওঠে সবুজ। যৌবন ফিরে পায় প্রকৃতি। দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসে উত্তাল ঢল।
শরতে সোমেশ্বরী নদীর তীরে কাশবনে ফুটে কাশফুল। শরতের আকাশে ভাসে শুভ্র মেঘের ভেলা। তখন বিরিশিরির চারদিকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় বহুগুন।
বিরিশিরি যাওয়ার উপায়
বাসে ঢাকা থেকে দূর্গাপুর
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বেশ কয়েকটি বাস সরাসরি দূর্গাপুর যায়। এদের মধ্যে রয়েছে সরকার ও জিন্নাত পরিবহণের বাসগুলি। তবে এসব বাস সরাসরি দূর্গাপুরের কথা বললেও দূর্গাপুর পর্যন্ত যায় না। এই বাসগুলি সাধারণত সুখনগরী পর্যন্ত যায়। ঢাকা থেকে বাসে ভাড়া পরবে জনপ্রতি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা।
সুখনগরীতে নেমে সেখান থেকে নৌকায় করে ছোট একটি নদী পার হতে হবে। নদীর ওপার থেকে রিকশা, বাস, টেম্পু, মোটর সাইকেলে করে দূর্গাপুর যেতে পারবেন। নদীর ওপারের রাস্তা খুব একটা ভালো নয়।
বাস বা রিকশার ক্ষেত্রে জনপ্রতি ভাড়া ২০ টাকা। রিকশায় গেলে ভাড়া পরবে ৮০-১০০ টাকা এবং মোটর সাইকেলে গেলে ভাড়া পরবে ১০০ টাকা, মোটর সাইকেলের ক্ষেত্রে ১০০টাকায় যেতে পারবেন দুজন। প্রতি জনে পরবে ৫০টাকা।
দূর্গাপুর থেকে নদী পাড় হয়ে ওপারে যেতে হবে। ওপার থেকে অটো কিংবা সিএনজি করে বিজেপি ক্যাম্প বা চীনামাটির পাহাড় যেতে পারবেন। ভাড়া পরবে জনপ্রতি মাত্র ৩০টাকা।
চাইলে বিরিশিরি থেকে ব্যাটারি চালিত রিক্সা ভাড়া করে বিরিশিরির সকল স্থান ঘুরে দেখতে পারেন মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০টাকা ভাড়ায়। মাত্র ৫-৬ ঘন্টার মধ্যে সকল স্থান ঘোড়া হয়ে যাবে। দলকরে গেলে এমনটাই করুণ।
দূর্গাপুর থেকে ঢাকায় ফেরার ক্ষেত্রে চলে আসুন দূর্গাপুরের তালুকদার প্লাজারের সামনে। এখান থেকে ১১টায় এবং ১১.৩০ মিনিটে দুটি নাইট কোচ ঢাকা মহাখালির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ফিরুন দূর্গাপুর থেকে ঢাকা।
ময়মনসিংহ থেকে বিরিশিরি
ময়মনসিংহ থেকে বিরিশিরি আসার ক্ষেত্রে প্রথমেই দেশের
যেকোন স্থান থেকে ময়মনসিংহ সদরে আসতে হবে। এবং অবশ্যই ভোঁর ৬টার আগেই ময়মনসিংহ পৌঁছাতে হবে। কারণ ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে লোকাল ট্রেনে ২০টাকা ভাড়ায় যেতে হবে জারিয়া ঝাঞ্জাইল।
আন্তনগর এক্সপ্রেসঃ ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ আন্তনগর ট্রেনের ক্ষেত্রে হাওর এক্সপ্রেস রাত ১১.৫০ এ কমলাপুর থেকে যাত্রা শুরু করে, ময়মনসিংহ পৌঁছে ৩.৫০ মিনিটে। এ ট্রেনটি বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। ভাড়া পরবে শোভন চেয়ারের ক্ষেত্রে ১৪০ টাকা।
মেইল ট্রেনঃ ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ আসার ক্ষেত্রে মেইল ট্রেন রাত ৯টায় ভাওয়াল এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করে, ময়মনসিংহ পৌঁছে ভোর ৫টায়। ভাড়া পরবে ২য় শ্রেণি সাধারণ সিটে ৩৫টাকা, কমিউটার ৬০টাকা এবং সুলভ সিটের ক্ষেত্রে ৭০টাকা। লোকাল ট্রেনে সময় লাগবে ৬-৭ ঘন্টা।
ময়মনসিংহ থেকে বিরিশিরি যাওয়ার ক্ষেত্রে ট্রেনে করে ময়মনসিংহ টু জারিয়া ঝাঞ্জাইল পর্যন্ত ২০টাকা ভাড়া পরবে। এ ট্রেনটি ভোর ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে যাত্রা শুরু করে। শেষ গন্তব্য জারিয়া ঝাঞ্জাইল। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবেন। সেখানে নেমে সিএনজি করে ৪০টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন দুর্গাপুর বাজার।
এছাড়া সরাসরি ময়মনসিংহ টু দুর্গাপুর বাসে করে যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ভাড়া পরে ১২০টাকা। তারপর নদী পার হয়ে ওপারে যেয়ে অটো বা সিএনজি করে বিজেপি ক্যাম্প, চীনা মাটির পাহাড় যেকোনো জায়গা ৩০টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন।
ঢাকা থেকে বিরিশিরি ময়মনসিংহ হয়ে ট্রেনে যাওয়া উত্তম। এতে খরচ হবে অনেক কম।
কোথায় খাবেন
বিরিশিরিতে ঘোরার সময় সাথে হালকা খাবার নিয়ে যাবেন, কারণ এখানে যেখানে সেখানে খাবার পাবেন না। এখানে মোটামুটি মাঝারি মানের কিছু হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে যেখানে মাছ, মাংশ অথবা বকের মাংশ দিয়ে পেট পুরে ভাত খেতে পারবেন।
তবে অবশ্যই দূর্গাপুর বাজারের বিখ্যাত বালিশ মিষ্টির স্বাদ নিতে ভুলবেন না যেনো। দূর্গাপুরের বালিশ মিষ্টি সমগ্র বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়।
কোথায় থাকবেন
দূর্গাপুরে বেশ কিছু মধ্যম মানের আবাসিক হোটেল, ডাকবাংলো ও রেস্টহাউজ রয়েছে। সেখানে রাত কাটাতে পারেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, YMCA রেস্ট হাউজ, YWCA গেস্ট হাউজ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি কালচারাল একাডেমী গেস্ট হাউজ।
দূর্গাপুরের মধ্যম-মানের হোটেলগুলোর মধ্যে রয়েছে নদী বাংলা গেস্ট হাউজ, হোটেল সুসং, হোটেল জবা, হোটেল গুলশান, স্বর্ণা গেস্ট হাউজ। এই হোটেলগুলোতে ২০০-৫০০টাকার মধ্যে রাত কাটাতে পারবেন।
ঢাকা থেকে বিরিশিরি ভ্রমণ খরচ
ঢাকা থেকে বাসে সুখনগরী ভাড়া ২৫০টাকা
সুখনগরী থেকে দূর্গাপুর বাস/রিকশা ভাড়া ২০টাকা
দূর্গাপুর থেকে চীনামাটির পাহাড় ও হৃদ ২০টাকা
সকাল - দুপুর - রাতের খাবার ১০০টাকা।
দূর্গানগর থেকে ঢাকা ৩০০
অন্যান্য খরচ = ১০০
সম্ভাব্য মোট খরচ = ২৫০+৩০০+১০০+২০+২০+১০০ = ৭৯০টাকা
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে দূর্গানগরের ক্ষেত্রে
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ট্রেনে ১৪০টাকা ভাড়া
ময়মনসিংহ থেকে জারিয়া ঝাঞ্জাইল ২০টাকা ভাড়া
জারিয়া ঝাঞ্জাইল থেকে দূর্গানগর সিএনজিতে ৪০টাকা ভাড়া।
দূর্গানগর থেকে চীনামাটির পাহাড় ও হৃদ ৩০টাকা ভাড়া।
সকাল - দুপুর - রাতের খাবার ১০০টাকা।
অন্যান্য খরচ = ১০০
ঢাকায় ফেরা ৩০০
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে চীনামাটির পাহাড় সম্ভাব্য মোট খরচ = ৩০০+১৪০+৪০+৩০+২০+১০০+১০০=৭৩০
সতর্কতা
- সারাদিনের জন্য অটো/সিএনজি ভাড়া করার ক্ষেত্রে দামাদামি করে নিবেন।
- বিরিশিরি, চীনামাটির পাহাড়, হৃদ এর অপরূপ সৌন্দর্যে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে এর পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।