প্রিয় মানুষের খোঁজে, সিলেটে - ভিন্নরকম এক অভিজ্ঞতা

Nir
2


আমাদের উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনখানা যখন ছাড়লো কমলাপুর স্টেশন থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে, তখন রাত সবে দশটা বেজেছে। দীর্ঘদিন পর সিলেটে যাচ্ছি, তাও আবার ঘুরতে নয়, প্রেমের টানে প্রিয় মানুষটার সাথে দেখা করতে। সেই মুহুর্তটাতে নিজেকে খুব এক্সাইটেড লাগছিল। তবে অবাস্তব হলেও সত্য, সিলেটে যাচ্ছি মাত্র সত্তুর টাকা হাতে নিয়ে। এ এক ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা।
ট্রেনে আমার সিট পড়েছে একদম শেষের সামনের সিটে, একটাই মাত্র সিট। চলার পথে সকাল থেকে কিছু না খাওয়ার দরুন পেটের খিদেটা তীব্র হয়ে গেলো। পকেটে মাত্র সত্তুর টাকা, যদি কিছু কিনে খাই তো সিলেটে গিয়ে বিপদে পড়ে যাবো, এই ভেবে কিছু না খেয়ে হাতের কনুই জানালার দিকে দিয়ে গালে হাত রেখে অন্ধকারাচ্ছন্ন বাহিরের পরিবেশ দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। চারদিকে অন্ধকার। দূরের বাড়িগুলোতে আলো দেখা যাচ্ছে। ভারি সুন্দর। হঠাৎ মনে হলো আমার ব্যাগে রুটি থাকার কথা, দুদিন আগে ঢাকায় আসার সময় মা বানিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু খাওয়া হয়নি। ব্যাগ থেকে রুটিগুলো বের করে দেখি সব রুটি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, রীতিমতো দূর্গন্ধও ছড়িয়েছে। তবে যাইহোক, খিদে তো পেয়েছে, চিনি ছিলো চিনি দিয়ে ওভাবে যেটুকু খেতে পারি খেয়ে বাকি রুটিগুলো জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে ফেলে দিলাম।
রাত যখন দুইটা, তখন আমাদের ট্রেনখানা এসে দাঁড়িয়েছে শ্রীমঙ্গলে – এখানে ক্রসিং হবে ঢাকাগামী ডাউন উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে। শ্রীমঙ্গলে এর আগে বহুবার এসেছি, এখানে আমার ভাইয়ের শশুর বাড়ি কিনা। শ্রীমঙ্গলের এ অঞ্চলখানি আমার বেশ ভালো লাগে, চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধুই চা বাগান আর চা বাগান। উঁচু নিচু পাহাড়ি বাকে বাক নেয়া চা বাগান গুলি দেখলে মন ভরে যায়, প্রান জুড়িয়ে যায়। আহ এ যেনো এক স্বর্গরাজ্য।
মিনিট দশেক যাত্রাবিরতির পর আমাদের ট্রেনখানা পূর্ণরায় চলতে লাগলো এবং কিছুক্ষনের মধ্যে লাউছড়া বনে ঢুকে গেলো। লাউছড়া অরন্যের বুক চিঁড়ে লাউছড়াকে অতিক্রম করে আমাদের ট্রেনখানা ছুটে চলেছে দূর হতে দূরে, বহুদূরে। একটু ঘুমানোর চেষ্ঠা করলাম, কিন্তু ঘুম যেনো কিছুতেই আসলো না। ব্যাগে সৈয়দ মুজতবা আলীর একখানা বই ছিলো, জলে-ডাঙ্গায়। বইখানা নিয়ে পড়তে লাগলাম। বলাবাহুল্য, সৈয়দ মুজতবা আলী আমার বেশ প্রিয় একজন লেখক। তার লেখা মোটামুটি সব বইয়েই অল্প বয়সেই পড়ে ফেলেছি।


দীর্ঘ ছয় ঘন্টা ট্রেনযাত্রার পর অবশেষে আমাদের ট্রেনখানা এসে যখন পৌছালো সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে, তখন ভোর পাঁচটা। ট্রেন থেকে যখন নামছিলাম, তখনকার অনুভূতিটা ছিলো বিষ্ময়কর এক অনুভূতি। প্লাটফর্মে কিছুক্ষণ পায়চারী করবার পর স্টেশন থেকে বাহিরে বের হলাম। একটা সিএনজি নেয়া দরকার, কিন্তু পকেটে মাত্র ষাট টাকা। আমার প্রিয় মানুষটা বলেছে সারে দশটায় টিলাগড় পয়েন্টে থাকতে, সে আসবে। কিন্তু তখন সবে সাড়ে পাঁচটা, এখনো অনেকটা সময় বাকি। একে তো পকেটে টাকা কম তার উপর সময়ও ঢেঁড় বেশি কাজেই এমন অবস্থায় সিএনজিতে চেপে টিলাগড় যাওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম পায়ে হেঁটে যাবো। রেলওয়ে স্টেশন থেকে টিলাগড়ের দূরুত্বটা খুব বেশি নয়, প্রায় সাড়ে চার কিলো হবে বৈকি!
চারদিকে আজান হচ্ছে, ফজরের আজান। নামাজ পড়া দরকার। সেখানকার একটা মসজিদে নামাজ পড়ে সেখানেই কিছুটা সময় অতিক্রম করে ফের হাঁটা পথ ধরলাম।
চারদিক ফাঁকা, কোথাও কেউ নেই। মাঝে মাঝে হালকা বাতাস বইছে। ভোরের আলো তখনো ফুটেনি। পথ ধরে যখন হাঁটছিলাম, মনের মধ্যে যেনো এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করছিলো। সূর্মা ব্রীজের উপরে উঠে খানিকটা সময় সেখানে কাটিয়ে ফের হাঁটা পথ ধরলাম।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমি যখন এসে পোছুলাম টিলাগড় পয়েন্টে, তখন সবে সাতটা বেজেছে। টিলাগড় চারমাথার মাঝে একটি ভাস্কর্য, তার সামনেই যে রাস্তাটাতে ফুট-অভার ব্রীজ – সেটির সামনেই মুরারিচাদ কলেজ, যেটি এমসি কলেজ নামে পরিচিত। ওই পথটা সোজা গিয়েছে শাহপরানের মাজার হয়ে জাফলং। এর ডানের রাস্তাটি গিয়েছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্রেই অবস্থিত শাহজালাল সাহেবের মাজার।
হাতে এখনো অনেক সময় বাকি, এতোটা সময় এখানে অবস্থান করাটা কিঞ্চিৎ বিরক্তকর মনে হলো। ফলস্বরূপ কিছুক্ষণ চারপাশ হেঁটে সিএনজিতে চেপে সোজা গেলুম শাহপরান সাহেবের মাজার।
শাহপরানের মাজারের প্রধান গেট থেকে কিছুটা হাঁটা পথ। রাতে স্টেশনে দুদিনে বাসি রুটি খেয়ে আছি, তাও একটুখানি। কাজেই আর হাঁটার জো নেই, শরির যেন চলছেই না। দীর্ঘক্ষন হাঁটার ফলে পিপাসাও লেগেছে বেশ। পিপাসা ও ক্লান্তি নামক যে কটি অসুবিধাজনক অসুবিধা মানবদেহকে বিব্রত করে থাকে আপাত তাদের নিরসন প্রয়োজন। কাজেই ছোট্ট একটি হোটেলে ঢুকে গেলাম। পকেটের টাকাটা বের করে দেখলাম, ইহাই সম্ভল। বেশি কিছু খাওয়া যাবেনা। নচেৎ বাসায় আর ফেরা হবে বলে মনে হয়না। কাজেই যেটুকুটে পেটটুকু বাঁচবে, সেটুকুই হলে হবে।
হোটেল ওয়ালাকে বললুম, ডাল পরাটা দিন তো। তিনি তার নিজের ভাষায় বললে; মাত্র দুইটা মিনিট অপেক্ষা করেন, এখুনি হয়ে যাবে। কাজেই দুইটা মিনিট অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিছুক্ষনের মধ্যে তিনি ডাল পরাটা এনে দিলেন। হোটেলে আমি ব্যাতিত আরেকজন মধ্যবয়সী লোক ছিলো। এখানকার স্থানীয়। তার সাথে কিছুক্ষণ গল্পের মধ্যে ঢুকে গেলাম। যদিও সিলেটী খুব ভালো বলতে পারিনা, কিন্তু আমার প্রেমিকা সিলেটী হওয়ার দরুন মোটামুটি ভালোই বুজতে পারি। একটা বিষয় লক্ষণীয়, আপনি এ অঞ্চলে কোথা থেকেই আসুন না কেনো, এ অঞ্চলের সবাই আপনার সাথে তাদের সিলেটী ভাষাতেই কথা বলবে। চলিত ভাষার প্রচলন দেখা যায় উত্তরবঙ্গে, বিশেষকরে রংপুর অঞ্চলে। উত্তরবঙ্গ ব্যাতিত সব অঞ্চলেই তাদের নিজ ভাষাকেই তাঁরা প্রাধান্য দেয় সর্বাধিক।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ, হোটেলের ভদ্রলোক মহাশয় আমার কাছ থেকে নিলেন খাওয়া বাবদ মোটে ত্রিশ টাকা, যদিও হয়েছিলো পঁচিশ – কিন্তু তার কাছে খুচরা না থাকার দরুন সেটা দিতে পারলেন না, শেষে কিনা পাচ টাকার চা কে দশটাকা বানিয়ে ত্রিশ বলে চালিয়ে দিলেন। হাতে মোটে রইলো ত্রিশখানা টাকা, ইহাই এখন ভরসা।
শাহপরানের মাজার পরিষ্কারের আয়োজন আরম্ভ হয়ে গেছে এতোমধ্যে, কিছুক্ষনের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেলো। লোকেরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। আমিও উঠলাম। যারা আগে উঠেছে তাঁরা শাহপরানের কবরে কবর জেয়ারত করে উলটো দিক দিয়ে নিচে নামতে লাগলো। এখানে নামার রীতিটা অনেকে উলটো দিক মানে, লোকে ভাবে পাচে যদি বেয়াদবি হয়ে যায় শাহপরান মশাইর সাথে – তাই এই আদবটুকু তাঁরা মেনে চলে। আমি অবশ্যি ভেবে পাইনে কাউকে আদব দেখাতে তার দিক তাকিয়ে পিছন দিক দিয়ে এগুতে হবে! অবশ্যি নিজের মতো করে একটা যুক্তি দার করালুম, হয়তো তাঁরা বিশ্বাস করে, পশ্চাৎদেশ কবরের দিকে রেখে সামনের দিকে এগুনো হয়তো তাদের কাছে বেয়াদবির পর্যায়ে চলে যায়। এই যুক্তিটা অবশ্যি মোটে মন্দ নয়।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলুম। বাকি সবাই দোয়া দরূদ পড়ছেন। কেউ কেউ নামাজ পড়ছে। কেউবা আবার কবর জিয়ারত করছেন। আবার অনেককে দেখলুম কবরকে সিজদাহ দিচ্ছেন। একজন মৃত্যু ব্যাক্তিকে সিজদাহ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত আমার জানা নেই। যাইহোক সেদিকে অগ্রসর না হওয়াই ভালো। কবরের পাশে এক কোণে বসে পড়লুম, মাঝে মাঝে এখানকার বৃদ্ধদের সাথে একটু গল্পও জুরে দিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে একজন আলেম ধরনের মধ্যবয়সী ব্যাক্তি এসে আমার পাশে বসলে, তার সাথে বেশ কিছুক্ষন গল্প করে কাটানো গেলো। লোকটা এখানকার স্থানীয়, কিন্তু জানা গেলো লোকটা অনেক জায়গায় গিয়েছেন, এমনকি আমাদের রংপুরেও গিয়েছেন। যদিও রংপুর শহরে নয়, রংপুরেরই একটা উপজেলা পীরগাছায়। যাইহোক পীরগাছায় যেতে হলেও রংপুর শহরের ভিতর দিয়েই যেতে হয়।
শাহপরানের মাজারের পাশে একটা মসজিদ, টিলার উপরে। যদিও তখনো অনেকটা সময় বাকি। ফলে মসজিদটার দিকে গেলুম, দেখি কয়েকজন ওখানে শুয়ে আছে। ভাবলুম একটু শুয়ে পড়া যাক। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ব্যাগ মাথায় রেখে শুয়ে পড়লুম। তবে ভয় অবশ্যি ছিলো, যদি ঘুম ধরে আর সময় মতো উঠতে না পারি! তার জন্য ফোনে এলার্ম দিয়েও রাখলাম, কিন্তু ঘুম চোখে এলো না।
ঠিক দশটা যখন বাজলো, তখন দ্রুত করে ব্যাগ ঘারে নিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তায় আসলুম এবং সেখানে সিএনজিতে উঠে পড়লুম, দ্রুত টিলাগড় পয়েন্টে যাওয়া দরকার, সময় একেবারেই কম।


মিনিট সাতেকের মধ্যে টিলাগড়ে এসে পৌঁছা গেলো। ঘড়িতে লক্ষ করলুম, বাজে দশটা দশ। এখনো বিশ মিনিট। এই সময়টাতে অবশ্যি নিজের মধ্যে যেনো অন্যরকম লাগা শুরু হয়ে গেছিলো। একধরনের উত্তেজনা ভাব। ভাবলাম কোথায় থাকা যায়, কোথায় থাকলে সে আমাকে দেখতে পারবে, টিলাগড় পয়েন্টটা তো মোটের উপর ছোট নয়। কখনো মনে হলো ফুট ওভার ব্রীজের ওখানে থাকি, কখনো বা ভাস্কর্য। যদিও আমি বলেছি ভাস্কর্যের ওখানে থাকবো। সর্বসাকুল্যে চারদিকেই ঘুরতে লাগলুম।
আমার প্রিয় মানুষটার সাথে যোগাযোগের সুযোগ ছিলোনা আমার, সর্বশেষ যখন কথা হয় ওর সাথে, তখন ওর আপু ম্যাসেজ দেখে ফেলে ফলস্বরূপ ফোনটা নেয় কেড়ে, ফলে ম্যাসেজ দিয়েও কোনো লাভ নেই, সিম বন্ধ।
হাতে মোটে ত্রিশ টাকা, বারবার মনে হচ্ছিলো প্রথমবারের মতো দেখা, তোফাকে কিছু দিবোনা এটা কি করে হয়! অনেক উপায় খুঁজেও উপায় পাচ্ছিলাম না, শেষমেশ পরিচিত একজনের থেকে দুইশত টাকা ধার নিয়ে সুন্দর দেখে একটা গোলাপী রঙয়ের ঘড়ি কিনে নিলাম, এই কালারটা আমার বেশ প্রিয়।
সময় যতই যাচ্ছিলো, নিজের মধ্যে ততই যেনো উত্তেজনা ভাবটা বেড়ে উঠছিলো। বলা বাহুল্য, রিলেশনের দেড় বছর পর এই প্রথম তার সাথে আমার বাস্তবে দেখা হবে। এর আগে তার সাথে আমার সবসময়ই কথা হতো ভিডিও কলে, সামনে ভিডিও কল চালু রেখে পড়তে বসতাম, আমার প্রিয় মানুষটা অবশ্যি বেশিরভাগ সময়ই পড়তো। আমাদের রিলেশনটা ছিলো অনেক গভীর, অনেক ডিপ। এক মূহুর্ত যেনো কথা না হলে অসুস্থ হয়ে যেতাম দুজনে। আমাদের রিলেশন শুরুর আগাগোড়া পুরোটাই পাঠক সে কাহিনী না হয় কোনো এক সময় আমার আত্মজীবনী থেকে জানবেন।
দশটা ত্রিশ বেজে গেল। তার আসার অপেক্ষার প্রহর গুনছি। কিন্তু সে সময় মতো আসতে পারলো না। ফলস্বরূপ আমাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হলো। এভাবে সাড়ে দশটা থেকে এগারো, এগারো থেকে বারো বারো থেকে একটা বেজে গেলো, তবুও সে নেই। মনটা তখন ভীষণ খারাপ হতে লাগলো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, সে আসবেই। কিন্তু আসছে না এখনো! মনে মনে ভাবলুম, হয়তো সুযোগ না পাওয়ার দরুন আসছেনা। সিদ্ধান্ত নিলাম রাত অব্ধি অপেক্ষা করবো, এখানেই, তবুও যদি সে না আসে, তবে আজ আর ফিরবো না, শহরেই ঘুরে ঘুরে রাত কাটাবো। কাল ওর কোচিং আছে, এ পথ দিয়ে নিশ্চয়ই ও যাবে।
এভাবে সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল কেটে গেলো। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। বারবার শুধু টিলাগড় পয়েন্টের চত্বর ঘুরতে লাগলুম। টিলাগড়ের আশপাশ অলিগলি গুলোতে হাঁটতে লাগলুম। এমসি কলেজের দিকেও গেলুম, ভিতরেও একপাক ঘুরলুম। ক্লান্ত হয়ে আবার টিলাগড় পয়েন্টে ফিরলুম।
সেখানে কিছু বালকের দেখা হলো। ছোট বাচ্চা। ছোট বাচ্চাদের আমার বেশ ভালো লাগে। তাদের সাথে কিছুক্ষণ ভাব জমালুম। ছোট বাচ্চাদের সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারি। ছোটদের জীবন কত্ত সুন্দর! এটা ছোট বেলায় বোঝা বড়ই কঠিন, কিন্তু বড় বেলায় বেশ বোঝা যায়।
ফুট ওভার ব্রীজের পাশে একটা ছেলে শরবত বিক্রি করছিলো। পিপাসা পেয়েছে বেশ, ফলস্বরূপ দুই গ্লাস শরবত মাত্র দশটায় খেলুম। সেখানে একটা বেঞ্চে বসে ছেলেটার সাথে খানিকক্ষণ গল্পও করলুম। জানতে চাইলুম, এখানে আশপাশ কোচিং কোথায়? আমার গার্লফ্রেন্ড এখানে থাকে, ওকে ভর্তি করায় দিবো!
যখন বাজে সাড়ে তিনটা, ঠিক তখন আমার ফোনে ম্যাসেজ এলো। দেখলুম, আমার তোফা ম্যাসেজ দিয়েছে। তখন মনটা যা ভরে গেছিলো। একদম শীতল হয়ে গেলো। দীর্ঘক্ষন অপেক্ষার অবসন ঘটলো। তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমি এখনো নাই কেনো?’ আমি সেই ছ’টা থেকে এখানে বসে আছি। সে বললে,
‘আমি আসতে পারবো না’
‘তাহলে আমাকে তোমার ঠিকানা দাও, আমি যাবো বাহির থেকে দেখেই ফিরবো।’
সে ঠিকানা দিলো এবং বললো পাঁচটার দিকে ওই জায়গায় যাইতে। সে যেখানে থাকে সেটি তার সামনের দিকটা। মনটা একদম ভরে গেলো। শান্ত হয়ে গেলো, একেবারে শীতল। ভাবলুম, যাই শাহপরান সাহেবের মাজার থেকে এই টুকু সময় কাটিয়ে আসি। বলা বাহুল্য, আমি আবার মাজাও পূজারী কিংবা মাজারের বা কোনো বাবা টাবার ভক্ত না। তবে শাহপরান যেহেতু একজন সম্মানী ব্যাক্তি, এ অঞ্চলে ইসলামের প্রচারে তার অবদান সর্বাধিক, সেই দিক দিয়ে ইতিহাস মন্ডিত সেই ব্যাক্তির দরগায় যাওয়া যেতেই পারে।


আমি যখন শাহপরানের মাজারের কাছাকাছি এসেছি, তখনি তোফা ম্যাসেজ দিয়ে বললে, আমি ছাদে আছি তুমি আসো।’ আমি রিপ্লাই দিয়ে বললাম, আমি শাহপরানের মাজারের কাছাকাছি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি। তড়িঘড়ি করে লেগুনা থেকে সেখানে নেমেই সিএনজিতে উঠে বসলাম, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে এলাম টিলাগড়। সেখানে সিএনজি থেকে নেমে দৌড়ে তার ঠিকানা। প্রথমে অবশ্যি ঠিকানা খুজতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হচ্ছিলো বটে, কিন্তু খুঁজে নিলাম। তার উপর পথে এক আধ বয়স্ক একজন লোক আমাকে দাড় করিয়ে কিছুক্ষণ আমার সাথে কথা বললো, সকালে সেই ভোরে দেখেছে কিনা তিনি নামাজ পড়ে হাঁটার পথে, তাই জিজ্ঞেস করছিল। বললুম এখানে আমার প্রিয় মানুষটার সাথে দেখা করতে এসেছি। তিনি এ সম্পর্কে আর কিছু বললো না। গালটা একটু স্পর্শ করলে, ভাব খানা এমন যেনো আমি খুকি বাচ্চা! তারপর বললে, যাও। আমি এই একটা জিনিস বেশ লক্ষি করেছি, যাদের সাথে আমার পরিচয় হয়, খুব সহজেই তাঁরা অনেকটা ভক্তের মতো হয়ে যায়। স্নেহের পাত্র হয়ে যাই তাদের কাছে।
ও যেখানে থাকে তার সামনের পথটা বেশ সুন্দর, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ছোট্ট একটা গলি, একদিক দিয়ে ড্রেন গিয়েছে সেই গলির ভিতর দিয়ে। ওখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েই ম্যাসেজ দিলাম, প্রথমে কোন বাড়িটা চিনতে সমস্যা হচ্ছিলো বটে, কিন্তু জানালার ওপারে একটা মেয়েকে দেখতেই চিনে ফেললাম, এ যে আমার তোফা! এক দৃষ্টিতে ওদিকে তাকিয়ে আছি। ও আমাকে হয়তো ঠিকভাবে চিনতে পারেনি ফলস্বরূপ ম্যাসেজ দিয়ে বললে কই তুমি? আমি তাকে আমার বর্ণনা দিলুম, নীল পাঞ্জাবী। তোফার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়ালাম, ও চিনে ফেললো।
আমার পাশে এখানকার স্থানীয় কয়েকজন ছেলে ছিলো। তাদের সাথেও বেশ কিছুক্ষণ আমার ভাব জমে গেলো। খানিকক্ষণ গল্প হলো তাদের সাথে, যদিও ওরা আমার কিছুটা ছোট। কিছুক্ষনের মধ্যে ছেলেগুলো চলে গেলো।
জানালার ওপারে আমার প্রিয় মানুষটা, তার মিটার দশেক দূরে আমি। আমার মাঝে একটা ছোট্ট পুকুর। সম্ভবত ওটা রান্নাঘর। দেখেই বুঝতে পেলুম চা বানাচ্ছিল। ওর চা খুব প্রিয়। সিলেটী মানুষ কিনা, চায়ের দেশ, কাজেই চা তো প্রিয় হবেই।
আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। আগে আমাদের ভিডিও কলে কথা হতো, খুবই। আমাদের ভালোবাসাটা অনেক গভীর ছিলো কি না। ও যখন পড়তে বসতো, তখন ফোন সামনে রেখে পড়তো, আমি দেখতাম। কথা বলতাম না, মাইক্রোফোন বেশিরভাগ সময়ই মিউট করা থাকতো।
আমাদের রিলেশনের শুরুটা হয় বেশ অদ্ভুতভাবে, পরিচয় ফেসবুকেই। পরিচয়ের মাসখানেকের মধ্যেই কম সময়েই সতেরো মার্চ দুই হাজার একুশ, আমাদের রিলেশনের শুরু। এটাই আমাদের প্রথম রিলেশন। এবং অনন্তকালের জন্য। তখন আমার কাছে ছিলো একটা অচল ফোন, কথা বলতে বলতে হুট করে ফোন হয়ে যেতো বন্ধ, আর সে কি রাগ! আবার এমনো হয়েছে, কথা বলতে বলতেই আমি গিয়েছি ঘুমিয়ে!
ওর দিকে তাকিয়েই আছি, চোখ যেনো সরাতেই পাচ্ছিনা, ভিডিও কলে যেরকম দেখেছিলাম, বাস্তবে তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর, মায়াবী। মিনিট দশেক এভাবে যাওয়ার পর ও আমাকে হাত বাড়িয়ে ঈশারা করে যেতে বললে, আমি ঈশারা করে বললুম আর একটু প্লিজ। এক পর্যায়ে ও জানালা বন্ধ করে দিলো। ম্যাসেজ করে যে একটু অনুরোধ করবো, কিন্তু এদিকে দেখি আমার ফোনে ব্যালেন্স শেষ! এক দৌড়ে টিলাগড়ে এসে এ দোকান ও দোকান করেও একটা দোকানেও লোক নেই, সবাই গেছে নামাজে। কোন সময় যে মাগরিবের আজান হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। সিলেটের এই একটা বৈশিষ্ট্য আমার বেশ ভালো লাগে, নামাজের সময় এরা অধিকাংশই দোকান ওভাবেই রেখে নামাজে যায়। যাইহোক খোজাখুজির পর একটা দোকানে লোক পেলুম, ঝটপট ব্যালেন্স ভরিয়ে এক দৌড়ে আবার পূর্বের জায়গায় এসে হাজির হলুম।
তখন জানালা খোলা ছিলো, কিন্তু জানালার ওপারে অন্ধকার। কেউ নেই। আমি থেকে গেলাম এই আসায় যে ও আবার আসবে জানালার কাছে, একটু দেখে বাসায় ফিরবো। কিন্তু ও আর এলো না।
এক পর্যায়ে একটা ছেলে আমাকে আমার নাম ও আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলো ভদ্রতা বজায় রেখে। ছেলেটাকে অবশ্যি পরিচিত লাগছিলো বটে, কিন্তু বাস্তবিকই তিনি আমার পরিচিত না। তার মতো দেখতে আমার পরিচিত কেউ ছিলো হয়তো, তাই পরিচিত লেগেছে। তাকে যখন বললুম, ‘আপনাকে কেনজানি চেনা চেনা লাগতেছে’। তিনি হয়তো আমার এ কথাটা শুনে মজা পেয়েছিলেন ফলে হেসে বললে, ‘আমাকে চিনো! তোমাকে তো কখনো দেখিই নাই!’ সে যাইহোক মানুষকে চেনা চেনা লাগতেই পারে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের সাথে কিছু কিছু মানুষের বেশ মিল থাকে। তবে ছেলেটির ব্যবহার ছিলো বেশ ভালো, সুন্নতি দাঁড়ি। তিনি আমাকে রাস্তায় নিয়ে গেলো। কিন্তু যার কাছে তিনি আমাকে নিয়ে গেলো তাকে দেখে আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভাবতেই পারিনি এমনটা হবে। তবে যেরকম ভাবে ছিলাম এমনটা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।


আমার সামনে যিনি, আমার বড় আপু। মানে আমার হবু বউয়ের বড় বোন। শুনেছি উনাকে উনার পরিবারের কমবেশি সবাই ভয় করেন। আমার প্রেমিকা তো সবথেকে বেশি। ফলস্বরূপ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় আমারও ভয় লাগছিলো, তবে তার পরিমাণ কিঞ্চিৎ। এক পর্যায়ে মনে হলো, আমি যদি তাকে ভয় করি আর তার কথার উত্তর গুলো দূর্বলভাবে দেই কিংবা নিজেকে দূর্বল্ভাবে প্রকাশ করি, তবে এ কেমন আমার ভালোবাসা! পাছে যেনো আমার তোফা আমাকে কাপুরুষ না ভাবে, এ ভেবে যাই হোক না কেনো সেখানেই থেকে গেলাম এবং প্রত্যেকটা উত্তর ভেবে চিনতে দিলাম। প্রথমে আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামটা অবশ্যি আমি মিথ্যা বলেছিলাম, মিথ্যার মধ্যে যাস্ট এইটুকুই। কিন্তু শেষে সেটা অবশ্যি সত্যিটা বলে দেই।
তিনি বললে,
‘তুমি যে এখানে আছো, তোমাকে যেতে বলার পরও থেকে গেলা, এটা কি ঠিক করেছো?’
আমি বললুম,
‘সে যেতে বলার পরও থাকাটা ঠিক করিনি, কিন্তু সে মুহুর্তে সেটা আমার মাথায় ছিলোনা। জীবনে প্রথম আমার প্রিয় মানুষটার সাথে আমার সরাসরি দেখা ফলে অন্যান্য চিন্তাভাবনা আমার মধ্যে ছিলোনা’
তিনি অবশ্যি ভদ্রতার শোহিত আমার সাথে কথা বলেছেন, এবং বলা যায় ছেলেটার থেকেও তিনি একটু বেশিই ভদ্রতা বজায় রেখেছিলেন।
তাঁরা হয়তো কিঞ্চিৎ অবাকই হয়েছিলেন, এতো দূর থেকে প্রেমের টানে সিলেটে এসে হাজির! কিন্তু তাঁরা একটা বিষয় ভুল বুঝেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন হয়তো আমি তোফাকে বিরক্ত করতে এসেছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস সেই ভাবনাটা তাদের কেটে গিয়েছিলো বটে কিন্তু সেটা তাঁরা প্রকাশ করেনি।
আপু বললে,
‘প্রেম করো ঠিক আছে, কিন্তু আগে প্রতিষ্ঠিত হও’।
আমি বললুম,
‘তা তো হবোই, তোফাও আমাকে টার্গেট দিয়েছে, এবং সেই লক্ষেই এগিয়ে যাচ্ছি ইনশাআল্লাহ্।’
আমার কথা বলার ধরণ দেখে তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন আমি নিশ্চয়ই ভদ্র ঘরের সন্তান। শুধু কথা বলার ধরনই না, আমাকে দেখেই। তিনি বললে;
‘তোমাকে তো দেখে ভদ্র ঘরের সন্তানই মনে হচ্ছে, কিন্তু তুমি কেনো এরকম হইছো!’
আমি অবশ্যি বুঝলাম না, মানুষ প্রেমের টানে ছুটে এলেই কি সে দোষী হয়! যাইহোক, কিছুক্ষণ সেখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা হওয়ার পর তাঁরা বললে, চলো চা খেতে যাবো। টিলাগড়ের পথে হাঁটতে হাঁটতে এমসি কলেজের দ্বিতীয় গেটের পথে যে রাস্তাটা সোজা গিয়েছে শাহজালালের মাজারের পথে, ওই পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এই পথটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রাস্তার বামপাশে টিলার উপরে বাড়িগুলো আর ডানপাশে এমসি কলেজ। সামনেই একটা চায়ের দোকান। এই দোকানে বেলা বারোটার দিকেও এক কাপ চা খেয়েছিলাম। সেখানে নিয়ে গেলো তাঁরা আমাকে, চা দিলো। বললুম,
‘চা এখন খাবো না, ভালো লাগবে না।’
ছেলেটা বললে,
‘আরে খাও খাও’
কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পর বললাম এখন চা টা খেয়ে নেই। ততক্ষণে পুরো চা জুরিয়ে হিম হয়ে গেছে। এক ঢোকে খেয়ে নিলাম।
এক পর্যায়ে আপু আমাকে বললে, তুমি তোফাকে ভুলে যাও। হবেনা এটা।
আমি তার কথা শেষ হতে না হতেই বললুম, ইট’স ইম্পসিবল। টোটালি ইম্পসিবল। আই কান্ট ফরগেট। নেভার। এটা কখনোই পসিবল না। তাদের কাছে একটি ইংরেজিও ব্যবহার করেছি বটে। ইংরেজি ভাষা জ্ঞানটা বলা যায় মোটামুটিভাবে বেশ আয়ত্ব করে ফেলেছি।
তিনি বললে,
‘তুমি বেশি কথা বলো’
আমি অবশ্যি সেই মুহুর্তে একটু বেশিই কথা বলা শুরু করেছিলাম। চা টা খাওয়ার পর এক রকমের ভয়ের ছিটেফোঁটাও ছিলোনা আমার মধ্যে, বরং এক ধরনের অদ্ভুত শাহস কাজ করছিলো। আমি মনে মনে আগে থেকেই স্থির করে নিয়েছি, যাই হোক না কেনো, আমি নত হবোনা, আমাকে ভুলে যেতে বললেও রাজি আমি কখনোই হবোনা। আমি ভয় পাবোনা।
তাঁরা আমার কাছে কলম আর খাতা চাইছিলো। আমি ডিরেক্ট বলে দিছি আমার কাছে খাতা কলম নাই। অবশ্যি এটাকে আংশিক মিথ্যা বলা চলে, খাতা ছিলোনা বটে কিন্তু একটা ডাইরি ছিলো। সৈয়দ মুস্ততবা আলীর বইটা বের করে দিয়ে বললাম এখানে শেষের পাতাটা ফাঁকা, এইটা ছিড়ে নেন। দেখতে চাইছিলাম এদের বইয়ের প্রতি কেমন ভালোবাসা। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বইটার সাদা পেইজটা ছিড়লোনা।
চায়ের দোকান থেকে আমাদের প্রস্থান ঘটলো। আমরা হাঁটতে লাগলাম সামনের দিকে ডানদিক দিয়ে।
একটু সামনে যেতেই হাতের ডানে ছোট ছোট পাহাড়সাড়ি চোখে পড়ে। সন্দেবেলায় সেগুলো যা দারুণ লাগছিলো! ফলে সেখানে খানিকক্ষণ বসে থাকলুম, ওরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওদেরকেও বসতে বললুম, ওদিকে দেখেন পাহাড়গুলো কত্ত সুন্দর! মহান রবের অপার সৃষ্টি। যদিও আমি পাঁচ হাজার ফিট পর্যন্ত উঁচু পাহাড়ে উঠেছি, এদিকের গুলা টিলা ধরনের, কিন্তু একটার সাথে আরেকটা লেগে থাকায় এগুলোকেও পাহাড় বলা যায়।
তাঁরা আমাকে উঠতে বললো, উঠলুম। আমরা আবার হাঁটতে থাকলাম। একটু সামনে একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললে, ওটাতে কি হয় জানো? আমি বললুম ওটা একটা অডিটোরিয়াম।
একটু সামনে গিয়ে ভাইটা একটা দোকান থেকে একটা অফসেট (এ৪) পেপার ও একটা কলম নিয়ে এলো। এবং আমাকে বললে, এখানে লেখো।
আমি খাতা কলম হাতে নিলাম, তাঁরা আমাকে লিখতে বললো। যা যা বললো ভেবে দেখলাম এগুলো লেখা যেতেই পারে। কারন এই লেখার সাথে কোনো সম্পর্ক নাই আমাদের রিলেশনে। লেখাটা অনেকটা এমন;

‘আজকে আমি তোফাকে বিরক্ত করিয়াছি। আমি ভুল করিয়াছি। আর কখনো তোফাকে বিরক্ত করিব না’

আমি তো আর তোফাকে বিরক্ত করিনি। আমি তোফাকে ভালোবাসি, তোফাও আমাকে ভালোবাসে। কাজেই এটা বিরক্তির তালিকায় পরে না। বিরক্ত তাকেই বলে, যখন মানুষ বিরক্ত অনুভব করে। কিন্তু এটা তো আর বিরক্ত না।
লেখাটা শেষে আমাকে পেইজটা ধরে থাকতে বললো, আপু পিক উঠাবে। আমি ধরে থাকলাম। পিক উঠানোর সময় ভাবলাম হ্যাপি মুডে তুলি নাকি দুঃখি মুডে! ভাবলাম, যদি হ্যাপি মুডে তুলি আর এটা তোফা দেখে না বুঝে মনে করে হুহ এতো বড় একটা লেখা লিখে হ্যাপি মুড! মলিনভাব করে থাকলাম, আপু পিক উঠালো।
এইতো, সর্বশেষ আমি সিএনজিতে উঠে চলে এলাম শাহজালালের মাজারে। কারণ তখন সবে সাতটা বাজে। আমার ট্রেন সাড়ে এগারোটায়। কাজেই ওখানেই বাকিটা সময় কাটালাম। ঠিক দশটায় রওয়ানা দিলাম স্টেশনের দিকে। রাতের সিলেট ভারি সুন্দর।
আমাদের ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনখানা যখন ছাড়লো, তখন সবে সাড়ে এগারোটা বেজেছে। সিলেট নগরীকে পিছনে ফেলে আমাদের ট্রেনখানা রওয়ানা দিলো ঢাকার উদ্দ্যেশে। 
বলা বাহুল্য, সিলেট থেকে ঢাকা ফেরার টিকেট পূর্বে থেকেই করার দরুন সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। তবে না খেয়ে থাকতে হয়েছে বৈকি। 
ট্রেনখানা যখন ঢাকা কমলাপুর বিমানবন্দরে এসে থামলো, তখন সাতটা বেজে গেছে। কমলাপুর থেকে পায়ে হেঁটে ফার্মগেটে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাই। তার কাছে কিছু বই নীলখেত থেকে কিনে রেখেছিলাম, সেই বইগুলো নিয়ে তার থেকে পঁচিশ টাকা ধার নিয়ে চলে আসি গাবতলিতে। গাবতলিতে এসে সেই পঁচিশ টাকাও শেষ। দীর্ঘক্ষন সেখানে সেই গরমে থেকে চারদিকে ফোন দেই, এক ভাইয়ের কাছে তিনশত টাকা এবং বাসায় ফোন দিয়ে তিনশত টাকা মোটে ছয়শত টাকা হলে টিকেট কেটে বাসে উঠে সন্ধ্যার পর ফিরি রংপুরের উদ্যেশে। 
দীর্ঘ ছয় ঘন্টা বাস যাত্রার পর অবশেষে বাসখানা যখন রংপুরে নামিয়ে দিলো তখন রাত ২টা, তখন পুরো রংপুর শহর বৃষ্টিভেজা। আকাশ মেঘে ঢাকা। মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো তবে তা অল্প সময়ের জন্য।
তখন রংপুর শহর পুরো ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। দীর্ঘক্ষণ রিকশা কিংবা অটোর অপেক্ষায় থেকেও না পেয়ে ব্যার্থ হয়ে হাঁটা পথ ধরলাম।
পেটে টানা চারদিন ধরে খাবার যায়নি, শুধু হাটছিই যার দরুন পায়ে হেটে বাসায় ফেরাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিলো। তবুও বাসায় যে ফিরতেই হবে, কোথাও আশ্রয় নেয়া যাবে না। রংপুর শহরকে আলো আঁধারির মাঝে যেনো অন্যরকম লাগছিলো। কোথাও কেউ নেই। বৃষ্টি এসে যেনো এই নগরিকে পবিত্র করে দিয়েছে। হাটছি আর ভাবছি, অনেক কিছু। তখন সামনে আকাশ চমকাচ্ছে। এই সামনে তো এই পিছে, এই বায়ে তো এই ডানে - আবার মাথার উপরে ততখনাত পুরো নগরি যেনো অন্যরকম আলোয় আলোকিত হয়ে যাচ্ছিলো। দৃশ্যটা ভারি মনোরম। ভারি সুন্দর। মাথা উচিয়ে থাকা গাছগুলো দোল খাচ্ছিলো হালকা বাতাসে। আহ কি শান্তি! নিজ শহর বলে কথা। কত সুন্দর, কত অপরূপ।
কত দূরে, কত অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমিতেই যাওনা কেনো। অপার সৌন্দর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে, সীমাহীন সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে মুক্ত মনের যত অগাধ আনন্দই পাওনা কেনো, মাটির কোলে ফিরে আসার মতো মধুময় অভিজ্ঞতা অন্য কিছুতেই নেই।

আমি অপেক্ষায় থাকবো। আছি। সারাজীবন।
 
"Oh sweet Tofa, thou art the beat of my heart and the light of my soul. My love for thee runs deep, like the rivers of Sylhet. Though thou art miles away in Tilagarh, thou art always near in my thoughts and my heart.
I long to hold thee, to bask in thy gentle embrace, and to whisper sweet nothings in thy ear. My love, my everything, I want to be thine forever.
Thou art my sunshine on a cloudy day, and the melody in my heart. I miss thee greatly, and I shall count the moments until we are reunited once again.
Tofa, my love, know that thou art cherished and adored. Until the end of time, I shall always be yours."
 
২৯/০৭/২০২২   

আরও পড়ুন;

সুন্দর জীবনের সন্ধ্যানে

অপরূপ গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি

 

Post a Comment

2Comments

এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।

Post a Comment

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!