ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর |
সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানিগঞ্জে অবস্থিত চমৎকার একটি গ্রাম ভোলাগঞ্জ। ভোলাগঞ্জ দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারিয়াম অঞ্চল। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জির কোল ঘেঁসে অবস্থিত ভোলাগঞ্জ। ওদিকের উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়গুলি, সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণাধারা, মেঘের ছুটাছুটি যেকাউকে মুগ্ধ করে তুলবে।
শীতে ভোলাগঞ্জ যৌবন হারিয়ে - হয়ে যায় উষ্কখুষ্ক, স্রোতহীন। তখন নদীতে পানির পরিমাণ থাকে অনেক কম। তার সৌন্দর্য কিঞ্চিৎ ম্লান হয়ে যায় বটে, কিন্তু সে সৌন্দর্যও কম না, যেকাউকে বিমহীত করবে। তবে ভোলাগঞ্জ যৌবন ফিরে পায় বর্ষায়, চারদিক হয়ে ওঠে সবুজ, দূরে নীল পাহাড়, মেঘের ছুটাছুটি, নদীতে স্রোত, অপার সৌন্দর্যে ভরে যায় ভোলাগঞ্জ। তখন একটুখানি পাথরের ওপরে বসে দূরের নীলপাহাড়, নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকুন একটুখানি, হাতে একখানা ডাইরি নিয়ে বসতে পারেন, অকবিত্ব মনে কবিত্বের আবির্ভাব ঘটবে মূহুর্তেই, সত্যিই পৃথিবীটা ভারি সুন্দর। এমন সৌন্দর্যের মাঝে - নিয়ে আসতে পারেন নিজের প্রিয় মানুষটাকেও।
দূরের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের দিকে তাকালে, মনে পড়ে যায় হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা যকের ধন বইখানা। ইচ্ছাকরে দূরের ঐ পাহাড়ে, খাসিয়া পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি বিমল আর কুমারের মতো ধনরত্নের সন্ধ্যানে। কোন এক রূপনাথের গুহায় নাকি রয়েছে সেই ধনরত্ন! সেখানে গিয়ে বাঘ-ভাল্লুকের সাথে কয়েকদিনে কয়েক বছরের জীবন কাটিয়ে আসি। গহীন অরণ্যে ধনরত্ন সন্ধ্যানী কখনোই ধনরত্নের লোভে যায় না, প্রবৃত্তির নেশা তাদের নেই। তাঁরা যায় অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়।
ভোলাগঞ্জ ভ্রমণের উত্তম সময়
ভোলাগঞ্জ যাবার উত্তম সময় বর্ষাকাল এবং তার পরবর্তী কিছু মাস। অর্থাৎ জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সময়টুকু ভোলাগঞ্জ যাবার উত্তম সময়। কারণ এই সময়টাতে নদীতে তখন পানি প্রবাহ বেশি থাকে। অন্যসময় গেলে পাথরময় ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন বটে, কিন্তু নদীতে পানিপ্রবাহের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হবেন। তবে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য সবসময়ই ভ্রমণপিপাসুকে মুগ্ধ করে।
ভোলাগঞ্জ যাওয়ার উপায়
সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৩৫ কিলোমিটার। কাজেই যেখান থেকেই আসুন না কেনো প্রথমে সিলেট শহর থেকে আসতে হবে। সেখান থেকে বাস, সিএনজি অথবা লেগুনায় করে যেতে হবে ভোলাগঞ্জে। চাইলে প্রাইভেট কারেও যেতে পারবেন।
ঢাকা থেকে বাসে সিলেট
ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ বা মহাখালি বাসস্ট্যান্ড থেকে অনেক বাস সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে গ্রীন লাইন, সৌদিয়া, শ্যামলী ও এনা পরিবহণ। এসব বাসের রয়েছে এসি এবং নন-এসি উভয় সার্ভিস। বাস প্রতি জনপ্রতি টিকেটের মূল্য পড়বে ১৪০০ থেকে ১৫০০। এসি বাসের ক্ষেত্রে ৬০০ থেকে ৮০০।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট
ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট যাওয়া উত্তম। ট্রেনে সিলেট যাতায়াতের ক্ষেত্রে ভাড়াটাও কম লাগে। ঢাকা থেকে সিলেটে যাওয়ার ক্ষেত্রে কমলাপুর অথবা বিমানবন্দর থেকে বেঁচে নিতে পারেন উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত অথবা কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনকে। ভাড়া পড়বে শোভন চেয়ারের ক্ষেত্রে জনপ্রতি ৩২০টাকা এবং এসি চেয়ারের ক্ষেত্রে ৬৪০টাকা। সময় লাগে কোনোটাতে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা। টিকেট কেটে নিতে পারেন অনলাইন থেকে সেখানে টাইম দেখে।
তবে যাতায়াতের জন্য উপবন ট্রেন উত্তম। ভোঁরে সিলেটে পৌঁছাতে চাইলে অবশ্যই উপবন এক্সপ্রেসে যাত্রা করতে হবে। উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনখানা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে ৮.৩০ এ এবং সিলেট পৌঁছে ভোঁর ৫টায়। ট্রেনে বর্তমানে বেশ ভালো ব্যবস্থা। মোবাইল চার্জ করার ও ব্যবস্থা রয়েছে। যেটি বেশ উপকারী।
সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ
ভোঁরে সিলেটে ট্রেন থেকে নেমে সকালের নাস্তা সেরে রওয়ানা দিন আম্বরখানায়। সিলেট রেলওয়ে থেকে আম্বরখানা ভাড়া পড়বে ৩০/৪০টাকা। গ্রুপ করে গেলে সিএনজি রিজার্ভ নিয়ে যেতে পারেন।
আম্বরখানা থেকে সিএনজি রিজার্ভ নিয়ে অথবা মজুমদারী এলাকা থেকে বিএরটিসি অথবা ট্যুরিস্ট বাসে যেতে পারেন। এখান থেকে সকাল ৮টা থেকে প্রতি ২০ অন্তর অন্তর এসব বাস চলাচল করে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এসব বাসে আপনি ভোলাগঞ্জ জিরোপয়েন্ট সাদা পাথর পর্যন্ত যেতে পারবেন। এসব বাসে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৭০টাকা।
লোকাল সিএনজির ক্ষেত্রে জনপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন। তবে রিজার্ভ নিয়ে গেলে ১২০০-১৪০০ এর মধ্যে হয়ে যাবে। তবে মাথায় রাখবেন, এক সিএনজিতে মোটে ৫ জন করে বসা যায়। আম্বুরখানা থেকে ভোলাগঞ্জ যেতে সময় লাগবে মোটে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের মতো।
ভোলাগঞ্জে নেমে সেখান থেকে দশ নম্বর নৌকা ঘাট থেকে সাদা পাথর যাওয়া-আসা সহ নৌকা ভাড়া পড়বে ৮০০টাকা। একটা নৌকায় মোটে দশজন ওঠা যায়। তবে কতৃপক্ষের নির্দেশনা হলো ৮জন। তবে তাদের একটুখানি বুঝিয়ে বললে সমস্যা হয় না, দশজনই ওঠা যায়। তাঁরা অনুমতি দেয়।
আপনি যদি একা যান, তবে সেখানে কিছু নৌকা রয়েছে যারা একজন একজন করে যাত্রী নিয়ে দশজন করে যাত্রা শুরু করেন। সেক্ষেত্রে একজনের ভাড়াটাই দিতে হয় যত হয় প্রতিজনের। তবে এক্ষেত্রে আপনি চাইলে কিছু গ্রুপ রয়েছে যেগুলোতে ৫-৭জন সদস্য থাকে, তাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন তাদের সাথে কথা বলে। তাঁরা অবশ্যই আপনাকে যুক্ত করবে। আমি ব্যাক্তিগতভাবে নিজেও এভাবে ঘুরি, যেগুলোতে রিজার্ভ করে যেতে হয়, সেই স্থানগুলোতে অন্যকোনো গ্রুপে যুক্ত হয়ে যায়। বিশেষকরে বান্দরবানের ক্ষেত্রে এইদিকটা বেশ সুবিধার। নির্ধিদায় সেখানকার অপরিচিত কোনো গ্রুপে যুক্ত হওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন
ভোলাগঞ্জে থাকার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকতে হলে আপনাকে আসতে হবে কোম্পানীগঞ্জে, ভোলাগঞ্জ থেকে কাছেই। তবে সেখানে ভালো মানের আবাসিক হোটেল পাবেন না, তবে কিছু মাঝারি মানের হোটেল রয়েছে। কোম্পানীগঞ্জে হোটেল আল হাসান, হোটেল আল ছাদিক, বাদশা বোর্ডিং, হালিমা বোর্ডিং ইত্যাদি সাধারণ মানের হোটেলে থাকতে পারেন।
কোম্পানীগঞ্জে একটি ডাকবাংলো রয়েছে, চাইলে সেখানেও থাকতে পারবেন।
তবে সকালে রওয়ানা হলে সন্ধ্যার মধ্যেই সিলেটে পৌঁছানো যায়। চেষ্ঠা করুণ সিলেটে শহরে ফিরে আসার। রাতে থাকার ক্ষেত্রে সিলেট শহর উত্তম। এখানে লালাবাজার ও দরগা রোডে রয়েছে অনেক কম ভাড়ায় মানসম্মত আবাসিক হোটেল ও রেস্টহাউজ। এসব হোটেলে থাকতে পারবেন ৫০০-১০০০ টাকার মধ্যে বেশ আরামে। উঠতে পারেন গুলশান, দরগা গেট, হোটেল হিল টাউন, কায়কোবাদ, সুরমা ইত্যাদি হোটেলে। অথবা আপনার পছন্দমতো যেকোনো হোটেলে উঠতে পারেন। এসব হোটেলে আপনার সামর্থ অনুযায়ী আপনি থাকতে পারবেন।
সতর্কতা
- ভ্রমণ শেষে সন্ধ্যার মধ্যেই সিলেট শহরে ফিরে আসার চেষ্ঠা করুণ।
- ভোলাগঞ্জ সীমান্তবর্তী জায়গা, কাজেই সাবধানে থাকুন।
- নদীপথে ভোলাগঞ্জ শুধুমাত্র বর্ষাকালেই যাওয়া যায়।
- যাতায়াতের সময় যানবহন ভাড়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই দরদাম করে নিবেন।
- খাওয়ার ক্ষেত্রে সেখানকার স্থানীয় হোটেলে খেতে পারেন।
- বর্ষায় পানির স্রত প্রচুর থাকে, কাজেই সাবধানে থাকুন।
- ভোলাগঞ্জে বা সিলেট শহরের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে যেখানে সেখানে দয়া করে ময়লা ফেলবেন না, যেখানে ময়লা ফেলে পরিবেশ নষ্টকারি ব্যাক্তিরা পরিবেশের শত্রু। পরিবেশ তাদের পছন্দ করেন না। আর পরিবেশ যাদের পছন্দ করেন না, তাদের মহান সৃষ্টিকর্তাও পছন্দ করেন না। কারণ এটা তারই দান।
এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।