চন্দ্রনাথ পাহাড় চট্রগ্রাম জেলার অন্তর্গত সীতাকুণ্ড উপজেলা থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি শুধুমাত্র হিন্দুদের তীর্থস্থানই নয় বরং ভ্রমনপিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয় একটি ট্রেকিং রুট চন্দ্রনাথ পাহাড়।
সীতাকুণ্ডের পূর্বদিকে চন্দ্রনাথ পাহাড় এবং এর পশ্চিমে সুবিশাল সমুদ্র সৈকত সীতাকুণ্ডকে করে তুলেছে অপরূপ সাজে সজ্জিত, প্রকৃতির লীলাভূমি। চন্দ্রনাথ পাহাড় যাবার পথে ব্যাসকুণ্ড থেকে শুরু হয়েছে অপরূপা পাহাড়সাড়ি।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সীতাকুণ্ড থেকে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। তবে সিএনজিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাড়া পড়ে ২০টাকা। পায়ে হেঁটে যাওয়ার ক্ষেত্রে আধা ঘন্টার মতো লাগবে সময়। পথে দেখতে পারবেন দুদিকের গাছগুলি, বাড়িগুলি এবং সামনেই দেখতে পারবেন ত্রিপুরাদের গ্রাম। এই অঞ্চলখানিতে হিন্দু ধর্মালম্বীদের বসবাস বেশ ফলে এখানে মন্দিরের দেখা পাবেন অনেক। দূরের পাহাড়সাড়ি হাতছানি দিবে আপনাকে। পথে হাতের ডানে পড়বে একটা একটা বেশ বড় মন্দির। এটা ব্যাসকুণ্ড। এখান থেকেই শুরু হয়েছে অপরূপা পাহাড়সাড়ি। একটু ভিতরে ঢুকে দেখতে পারেন। এখানে ভিতরে একটা পুকুর আছে, এটাকে বলা হয় ব্যাসকুণ্ড। কিংবদন্তী আছে এ কুণ্ডতে ব্যাসদেব স্নান করতেন। ফলে হিন্দু ধর্মালম্বীরা এ পুকুরে ডুব দিয়ে পূজার উপকরণ নিয়ে রওয়ানা দেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উদ্যেশে তীর্থ যাত্রায়। ব্যাসকুণ্ডের কাছেই বাহিরে দেখবেন সুবিশাল এক বটবৃক্ষ, এটিকে বলা হয় বটুবৃক্ষ। কিংবদন্তী আছে, শ্রী ব্যাসদেব এখানে বসে রচনা করেছিলেন মহাভারতের একটি অধ্যায়।
আপনি যেহেতু হাঁটাপথে যাচ্ছেন, সেই সুবাধে একটুখানি হিন্দুদের ধর্মীয় স্থাপনা এবং উপজাতিদের জীবনব্যবস্থাখানি দেখে নিতে পারেন। পাহাড়ের একটুখানি গভীরেও যেতে পারেন, সেখানে চোখে পড়বে জুমখেত। জুমখেত হলো যেখানে পাহাড়ের মধ্যে নানান ধরনের ফসল ফলানো হয়। এখানে ফুলের বাগানও রয়েছে যা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
কীভাবে যাবেন চন্দ্রনাথ পাহাড়
আপনি
যেখানেই থাকুন না কেনো প্রথমে সেখান থেকে সীতাকুণ্ডে আসতে হবে। নানাভাবে আপনি সীতাকুণ্ডে আসতে পারেন। এখানে ঢাকা ও চট্রগ্রাম থেকে বাস এবং ট্রেনে আসার উপায় দেয়া হলো।
ঢাকা থেকে বাসে সীতাকুণ্ড
ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি সীতাকুণ্ডে যেতে পারেন। সায়েদাবাদ, ফকিরাপুর, মহাখালি বাসস্ট্যান্ড হতে শ্যামলি, এস আর, সৌদিয়া, হানিফ, এনাসহ অনেক বাস চট্রগ্রাম রুটে চলাচল করে। এসব বাসের টিকেট কাটতে পারেন। এক্ষেত্রে নন-এসি বাসে টিকেট পড়বে জনপ্রতি ৪২০ থেকে ৪৮০ এবং এসি বাসের ক্ষেত্রে জনপ্রতি ৮০০ থেকে ১১০০টাকার মধ্যে হয়ে যাবে।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সীতাকুণ্ড
ট্রেনে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে ঢাকা থেকে আসতে হবে ফেনিতে। এক্ষেত্রে জনপ্রতি টিকেট পড়বে শোভন চেয়ারের ক্ষেত্রে ২৬৫টাকা এবং এসিতে ৭৯০টাকা। এক্ষেত্রে রাত ৯.২০ এর ট্রেন মহানগর এক্সপ্রেস অথবা রাত ১১.৩০ এর ট্রেন তুর্না এক্সপ্রেসে উঠতে পারেন। ফেনী রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১০টাকা ভাড়ায় চলে যেতে হবে ফেনী মহিপাল বাস স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে লোকাল বাসে করে ৫০-৮০টাকা ভাড়ায় চলে যান সীতাকুণ্ডে। চেষ্ঠা করুণ তুর্ণা এক্সপ্রেসে ওঠার, কারণ এটি ফেনীতে নামিয়ে দিবে ৪.৩৫ এ।
অথবা আপনি চাইলে ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেনে করে সীতাকুণ্ডে আসতে পারেন, তবে সেটি মেইল ট্রেন। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১২০টাকা। এই ট্রেনটি রাত ১০.৩০ মিনিটে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে। সীতাকুণ্ডে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। তবে এই ট্রেনে সিট পেতে হলে আপনাকে অনেক আগে থেকেই ট্রেনে উঠে টিকেট করে সিটে বসে পড়তে হবে, নইলে পুরোটা পথ দাঁড়িয়ে যেতে হবে। কারণ এই ট্রেনে মুহুর্তেই সিট সব ব্লক হয়ে যায়। এবং আপনাকে নিজ দায়িত্বে সাথে যা যা নিবেন সতর্কতার সাথে রাখবেন। যারা কম খরচে সীতাকুণ্ড ঘুরতে চান তাঁরা এটা অবলম্বন করতে পারেন।
চট্রগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড
চট্রগ্রাম
থেকে সীতাকুণ্ডে আসার ক্ষেত্রে চট্রগ্রাম নগরীর অলঙ্কার মোড় কিংবা এ কে খান থেকে লোকাল বাসে ভাড়া পড়বে ৫০-৮০টাকা।
চট্রগ্রাম থেকে রওয়ানা দেয়ার ক্ষেত্রে চেষ্ঠা করুণ খুব ভোঁরে রওয়ানা
দিতে। অথবা দলগতভাবে গেলে রিজার্ভ গাড়ি নিতে পারেন।
মূলকথা যেখান থেকেই আসুন না কেনো প্রথমে আপনাকে সীতাকুণ্ডে আসতে হবে। বাসের ক্ষেত্রে প্রতিটা চট্রগ্রামগামী বাসই সীতাকুণ্ডের উপর দিয়ে যায়।
সীতাকুণ্ড থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়
সীতাকুণ্ড থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড় রোডে সোজা হাঁটাপথে ৩০ মিনিটের মাঝে পৌঁছে যাবেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের একদম পাদদেশে। সিএনজিতে আসার ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ২০টাকা। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার আগে একটা লাঠি কিনে নিন ২০টাকা দিয়ে। ফেরার পথে লাঠিটি যার থেকে নিয়েছেন তাকে জমা দিলে ১০টাকা ফেরত পাবেন।
এখন আপনাকে সোজা উঠতে হবে। ওঠার পথে চোখে পড়বে একটা ঝর্ণা। বর্ষায় এটাতে পানি থাকে অনেক, কিন্তু শীতে সব পানি ফুরিয়ে যায়, তখন ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ে। এই ঝর্ণার কাছে এলে দেখবেন রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। দুটাই চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠেছে। ডান দিকের পথটা পাহাড়ে ওঠার জন্য কিন্তু এটা পুরোটাই সিঁড়ি পথ কিন্তু বামদিকেরটা পাহাড়ি পথ, সিঁড়ি একেবারেই কম এবং কিছু কিছু জায়গা বিপজ্জনকও বটে। কিন্তু ভুলেও ডানদিকের সিঁড়ি পথে উঠতে যাবেন না, এটা ওঠার জন্য বেশ কঠিন। দেখা যাবে উঠতে উঠতে আপনি হাঁপিয়ে গেছেন একেবারে। তাছাড়া এই পথটা বেশ খাড়া। পাহাড়ি পথে ট্রেকিং তুলনামূলক সহজ। কাজেই চেষ্ঠা করুণ বামদিকের পথ ধরে ওঠার এবং নামার সময় অবশ্যই নামবেন ডানদিকের পথ ধরে। সবাই এটাই করে। যারা জানেনা তারাই একমাত্র ডানদিকের পথ ধরে উঠতে গিয়ে ভুল করে বসে।
দীর্ঘক্ষন হাঁটার পর দেখবেন একটা মন্দির। এটা হলো বিরূপাক্ষ মন্দির। এই মন্দির থেকে মাত্র ১৫০ ফিট উপরেই চন্দ্রনাথ পাহাড়। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন আর চারদিকের পাহাড় ঘেরা সীতাকুণ্ডকে উপভোগ করুণ। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার পথে কিছু দোকান পাবেন সেগুলো থেকে সরবত ও শুকনা খাবারও কিনে খেতে পারেন। তারপর উঠে পড়ুন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। এই ১৫০ মিটারের মধ্যে প্রায় ১০০মিটারই উঠতে হবে বেশ খাড়া পথ। কাজেই এখানে সতর্কতা অবলম্বন করুণ।
চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে একদিকে দেখবেন দূরের বঙ্গোপসাগর আরেক দিকে সীতাকুণ্ড বাজার আর চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে দিন, মহান সৃষ্টিকর্তার অপার সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করুন।
কোথায় থাকবেন
আপনি যদি সীতাকুণ্ডে থাকতে চান সেক্ষেত্রে সৌদিয়া, সাইমমসহ সীতাকুণ্ড বাজারে বেশ কয়েকটি মাঝারি মানের হোটেল আছে। সৌদিয়ায় বুকিং দিতে পারেন 01991787979, 01816518119 এই নাম্বারে।
ভালো কোথাও থাকতে চাইলে চট্রগ্রাম অলঙ্কার মোড়ে থাকতে পারেন, এখানে বেশ কিছু ভালো মোটামুটি মানের হোটেল রয়েছে যেখানে ৬০০-১৫০০টাকার মধ্যে রাত্রি যাপন করতে পারবেন। এছাড়াও স্টেশন রোড, জিইসি রোড, নিউমার্কেটের পাশে রয়েছে বেশ কিছু হোটেল।
সীতাকুন্ডের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানসসমূহ
- গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত
- বাশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত
- খৈয়াছড়া ঝর্ণা
- সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক
- ঝরঝরি ঝর্ণা
- নামিত্তাছড়া ঝর্ণা
- কমলদহ ঝর্ণা
- কুমিরা সন্দ্বীপ ফেরি ঘাট
একদিনে চন্দ্রনাথ পাহাড় ভ্রমণ হিসাব
ঢাকা থেকে রাত ১০.৩০ এর মেইল ট্রেনে সীতাকুণ্ড যাওয়া ১২০ এবং আন্তনগর চাটলা এক্সপ্রেসে রাত ১১টার সময় ফেরা ২৬৫ অর্থাৎ যাওয়া আসা মিলে ৩৮৫ এবং সকাল দুপুর রাতের খাবার মিলে ১৫০ এক্ষেত্রে ডাল, পরাটা খাবার চেষ্ঠা করবেন, ভাতের ক্ষেত্রে ডাল, ডিম, ভর্তা দিয়ে চেষ্ঠা করবেন এবং অন্যান্য খাবার ১০০ মোটে ৬৩৫টাকায় একদিনে চন্দ্রনাথ পাহাড় ঘুরে আসতে পারবেন।
একদিনে তিনটা স্থান অর্থাৎ চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির, খৈয়াছড়া ঝর্ণা এবং গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত মাত্র ১০৬০টাকায় কম খরচে একদিনের ট্যুর প্ল্যানটি দেখে নিতে পারেন। এখানে পাহাড়, ঝর্ণা এবং সমুদ্র সৈকত একদিনে দেখা হয়ে যাবে।
কম খরচে একদিনে সীতাকুণ্ড ভ্রমণের বিস্তারিত গাইড
কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উচ্চতা কত?
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ১১৫২ ফুট অর্থাৎ ৩৫১ মিটার। চন্দ্রনাথ পাহাড় চট্রগ্রাম জেলার সর্বোচ্চ স্থান যা সীতাকুণ্ড শহরের পূর্বে অবস্থিত।
চন্দ্রনাথ পাহাড় কী ঢাকা থেকে একদিনে ভ্রমণ সম্ভব?
হ্যাঁ, চন্দ্রনাথ পাহাড় ঢাকা থেকে একদিনে সম্ভব। সেক্ষেত্রে পূর্বের দিন রাতে রওয়ানা দিতে হবে সীতাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে এবং সকালের মধ্যেই সীতাকুণ্ডে পৌঁছাতে হবে।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠতে কত সময় লাগে?
স্বাভাবিক ভাবে হাঁটলে দেড় ঘন্টার মধ্যে ওঠা যাবে তবে দ্রুত হাঁটলে ঘন্টাখানেকের মধ্যে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শীর্ষে উঠা সম্ভব।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সিঁড়ির সংখ্যা কতটি?
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সিঁড়ির সংখ্যা মোটে ২২০০ এর মতো।
সীতাকুণ্ডের দর্শনীয় স্থান কী কী?
সীতাকুণ্ডে রয়েছে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মন্দির, গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত, সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক, মহামায়া লেক, বাশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত, কুমিরা ঘাট, ঝরঝরি ঝর্ণা ট্রেইল ইত্যাদি।
এই পোস্টটি বিষয়ে আপনার যদি কোনো মন্তব্য থাকে তাহলে নিচে কমেন্ট করুণ। অতি দ্রুত রিপ্লাই পাবেন।